সারা বাংলা

১ ঘণ্টার বাজারে কোটি টাকার দুধের বাণিজ্য

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নের গোপালপুরে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বড় দুধের বাজার। পরিচিতি পেয়েছে ‘এক ঘণ্টার বাজার’ নামে। ধলেশ্বরী নদীর পূর্বপাড়ের এই গোপালপুর বাজারে বিক্রি হয়ে শ’ শ’ মণ দুধ। আয়ও চমকে ওঠার মতো। ২৫০ থেকে ৩০০ মণ দুধ বিক্রি থেকে মাসে আয় হয় দুই কোটি টাকা। এই দুধ বেচাবিক্রির সঙ্গে যুক্ত ১৫ গ্রামের প্রায় ৩০০ ছোটবড় খামারি। 

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন সকাল ৯টায় কর্মচঞ্চল থাকে এই বাজার। ১০টা পর্যন্ত চলে দুধ কেনাবেচা। যদিও বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশ কষ্ট পোহাতে হয় দুধ বিক্রেতাদের। নদীর পশ্চিমপাড়ের রাজৈর, বরাইদ, কাকরাইদ, গালা, তিল্লির চর, নাটুয়াবাড়ীসহ আশপাশের গ্রাম থেকে আসতে হয় খেয়া পারাপারে। তারপর তাদের দেখা যায় দুধ ভর্তি সিলভারের কলস মাথায় নিয়ে হাঁটতে।

বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশ কষ্ট পোহাতে হয় দুধ বিক্রেতাদের।

এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি হলেও গাভি পালন এখন অন্যতম আয়ের উৎস। প্রায় প্রতিটি কৃষকের বাড়িতেই পাঁচ থেকে ১০টি করে গাভি রয়েছে। বাজারে পাইকাররা সেই দুধ কিনে প্লাস্টিকের ড্রামে সংরক্ষণ করে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেন।

সম্প্রতি গোপালপুর গ্রামের রাজৈর এলাকার কয়েকজন ক্ষুদ্র খামারির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভোরবেলা থেকেই তারা গোয়ালঘরে দুধ দোয়ানোতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। কেউ গাভির বাট পরিষ্কার করে তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন, আবার কেউ দুধ দোহন করে কলসিতে ভরছেন। এই দুধ বাজারে লিটারপ্রতি বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকায়।

উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নের কাকরাইদ গ্রামের সোরাব মিয়া জানান, তিনি ৩০ বছর ধরে গাভি লালন-পালন করছেন। তার খামারে পাঁচটি গরু রয়েছে, যার মধ্যে চারটি দুধ দেয়। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ কেজি দুধ সংগ্রহ করেন। বাজারে এই দুধ ৬০ থেকে ৭০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হয়, যা দিয়েই চলে তার সংসার।

তিদিন এখানে আট লাখ টাকার বেশি দুধ বিক্রি হয়।

রাজৈর গ্রামের তোবারক হোসেনের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। তার খামারে চারটি গাভি রয়েছে, যেগুলো প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ কেজি দুধ দেয়। দুধ বিক্রির টাকাই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জন।

ঢাকা থেকে আসা পাইকারি দুধের ক্রেতা আব্দুল করিম জানান, তিনি গোপালপুর বাজার থেকে নিয়মিত দুধ কেনেন। প্রতিদিন ভোরেই তিনি তার কর্মচারীদের সঙ্গে পিকআপ ভ্যানে এসে বাজারে পৌঁছান।

আব্দুল করিম বলেন, “আমি প্রায় পাঁচ বছর ধরে গোপালপুর বাজার থেকে দুধ কিনি। এখানকার দুধের মান ভালো। তাই প্রতিদিন আমাদের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ মণ দুধ কেনা হয়। এই দুধ ঢাকায় মিষ্টির দোকান, চায়ের দোকান আর হোটেলগুলোতে সরবরাহ করি।”

গোপালপুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. আবুল হোসেন বলেন, “প্রতিদিন এখানে আট লাখ টাকার বেশি দুধ বিক্রি হয়। পাইকাররা এই দুধ ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় সরবরাহ করেন। গোপালপুর এখন দুধের জন্য প্রসিদ্ধ একটি বাজার।”

সবচেয়ে বড় সমস্যা ধলেশ্বরী নদীর ওপর একটি সেতুর অভাব।

তবে, বাজারটি দেশের অন্যতম বড় দুধের বাজার হলেও এখানে বেশ কিছু সমস্যাও রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ধলেশ্বরী নদীর ওপর একটি সেতুর অভাব। কৃষকদের খেয়া নৌকায় দুধ আনতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টকর।  লুৎফর মিয়া দুধ নিয়ে এই বাজারেই আসেন। তিনি বলেন, “আমরা বহুদিন ধরে একটা ব্রিজের দাবি জানিয়ে আসছি। ব্রিজ হলে আমাদের জীবন-যাপন অনেক সহজতর হতো।’’

সেতু নির্মাণ ও বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন হলে এই অঞ্চলের দুধ ব্যবসা আরও প্রসারিত হবে বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

টেন্ডারের কাজ সম্পন্ন হলে কয়েক মাসের মধ্যে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে।

এ বিষয়ে সাটুরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী ( এলজিইডি) মো. ইমরুল হাসান বলেন, “ব্রিজের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টেন্ডারের কাজও সম্পন্ন হলে কয়েক মাসের মধ্যে কাজ শুরু হবে।”

মানিকগঞ্জ জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, “ওই এলাকায় গবাদি পশুর উন্নয়নে উঠান বৈঠক, ঘাস উৎপাদন, খামারিদের প্রশিক্ষণসহ একাধিক কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। ফলে গোপালপুর দুধের বাজার গুণগত মানের দুধ বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি বাড়িতেই গাভী পালন করে সবাই সাবলম্বী হচ্ছেন।”