ক্যাম্পাস

মা আমার মায়াবতী পাহাড়

বয়স বাড়ছে, ক্লাসের ব্যাগ ভারী হচ্ছে, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় হতে চাইছে আমার স্বপ্নগুলোও। প্রতিদিন নতুন কোনো লক্ষ্য যোগ হয় জীবনের তালিকায়। তবে লক্ষ্য যতই বড় হোক না কেনো, তার পেছনে আমি কখনো মাকে বাদ দিয়ে কিছু ভাবতে পারি না। আমার জীবনের প্রতিটি সকালে, প্রতিটি সন্ধ্যায়, প্রতিটি ক্লান্ত বিকেলে মায়ের ছায়া আছে। আমার জীবনের সবকিছুতে মা আছেন।

আমি যখন পড়ার টেবিলে বসি, পাশের ঘর থেকে মৃদু শব্দে চায়ের কাপ রাখার শব্দ পাই, বোতল গরম করার শব্দ শুনি, মায়ের নিঃশব্দ উপস্থিতি টের পাই। কখনো চোখ মেলে তাকালে দেখি, সেই পরিচিত মুখটা। যে মুখে আমার ক্লান্তি গলে গিয়ে শান্তি হয়ে যায়, সে মুখ আমার মায়ের।

আমি একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। অভাব তেমন নেই, কিন্তু হিসাব করে চলতে হয় প্রতিটি পদক্ষেপে। আর সেই হিসাব মেলানোর দায়িত্বটা অনেকটা একা কাঁধে তুলে নিয়েছেন আমার মা। বাবার রোজগারে সংসার চলে, কিন্তু সংসারের প্রতিটি কোণে যে ভালোবাসার আলপনা আঁকা, তার শিল্পী মা। সংসার জোড়া থাকে মায়ের অসীম ধৈর্য, নিঃশব্দ সংগ্রাম আর অবিরাম ভালোবাসায়।

আমার মা দুধে-আলতা গায়ের, গালভরা হেসে কথা বলেন। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, মা নিজের জন্য কিছু রাখেননি কখনো। ঈদের নতুন জামা কিনতে গেলেও আমাদের আগে কিনে দেন। আর নিজের জন্য কোনোবার হয়তো পুরনো একটা ওড়নাই নতুন করে ভাঁজ করে পরেন।

মায়ের সেই নির্লোভ জীবন আমাকে শিখিয়েছে, ভালোবাসা মানে কী, ত্যাগ মানে কী। মা সবসময় পেছনে থেকেছেন। অথচ মা না থাকলে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথটাই হয়তো তৈরি হত না।

মনে পড়ে, ছোটবেলায় একবার পরীক্ষায় খারাপ করেছিলাম। সবাই রেগে গেছে, কথা বন্ধ। মা একমাত্র পাশে বসে বললেন, “তুই তো নিজেই কষ্টে আছিস, আমি তোকে আর কষ্ট দিতে চাই না। পরের বার ঠিক হয়ে যাবে।” সেই ছোট্ট কথাটা আমার জীবনের দিক বদলে দিল। আজো কোনো কঠিন সময় এলে আমি শুধু মায়ের মুখটা মনে করি। মায়ের মুখ মানেই ভরসা, আশ্বাস, আবার নতুন করে পথচলার শক্তি।

মা সারাদিন কাজ করেন। রান্না, ঘর পরিষ্কার, ভাইয়ের অফিস, আমার বিছানা গোছানো, বাবার ওষুধ সবকিছু সামলে তারপরও আমার খোঁজ রাখেন। অথচ আমি অনেক সময় বিরক্ত হই, চিৎকার করি, রাগারাগি করি। মা কিছু বলেন না। শুধু একবার বলেন, “তুই না খেয়ে থাকলে আমার বুকটা মোচড় দেয়।” সেই কথার গভীরতা আমি বুঝি তখন, যখন আমি একা থাকি। মায়ের গলা শুনতে ইচ্ছে করে।

অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকে জীবনটা অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। ক্লাস, পরীক্ষা, টিউশনি সবকিছু মিলিয়ে সময়ই থাকে না। বাসায় ফিরতে দেরি হয়, ফোনে কথা হয় কম। তবু মা প্রতিদিন একই কথা বলেন, “তরকারি গরম করে দেব?” সেই ছোট্ট প্রশ্নের ভেতর লুকিয়ে আছে মায়ের হাজারটা না বলা ভালোবাসা, যত্ন আর অপেক্ষা।

আজো মা নিজের জন্য কিছু চান না। বলেন, “তুই মানুষ হ, ওটাই আমার পাওয়া।” কী সহজ, অথচ কী গভীর কথা! এত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা শুধু মা-ই দিতে পারেন।

আজ মা দিবস। আমি মাকে কোনো দামি উপহার দিতে পারিনি। শুধু এই লেখাটা দিয়েছি তার পায়ে ভালোবাসার এক বিনম্র শ্রদ্ধা হিসেবে। জানি, এটা উপহার নয়। কিন্তু যদি কেউ এই লেখাটা পড়ে, বুঝবে মা কী। মা মানে কতটা বিশাল এক আশ্রয়।

মা মানে আগলে রাখা আকাশ, বুকের ভেতর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়। মা মানে আলো, আশ্রয়, নির্ভরতা। মা মানেই ভালোবাসা। মা মানেই আমার পৃথিবী।

(লেখক: শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সরকারি তিতুমীর কলেজ)