একটি সময় ছিল, যখন যৌথ পরিবারে বসবাস ছিল বাংলার ঐতিহ্য। কিন্তু সমাজের সংকীর্ণতার কারণে সেই যৌথ পরিবার আজ ভেঙে টুকরো টুকরো। ঠিক এমনই একটি ভাঙা সংসারে বাস করত শুভ্রাংশুর পরিবার। চারজন সদস্যের সেই ক্ষুদ্র সংসারে আয়ের উৎস ছিল মাত্র একজন—শুভ্রাংশুর বাবা। একটি ছোট ব্যবসা কোনোমতে চললেও তাতে সংসার চালানো ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। তার উপর ছিল ধনীর মতো কিছুটা বাহ্যিক আচার–আচরণ, যা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলত।
শুভ্রাংশু ছিল পরিবারের বড় সন্তান—ভদ্র, নম্র এবং বুঝদার। ছোট হলেও সে তার সামান্য ইচ্ছার কথাগুলো বাবার কাছে বলত। কিন্তু বাবা অধিকাংশ সময়ই সেগুলো পূরণ করতে পারতেন না। এই কঠিন বাস্তবতার মাঝে আশার আলো হয়ে উঠেছিলেন তার মা। তিনি শিক্ষিতা নারী, যার জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ তৈরি করা।
শুভ্রাংশুর শিক্ষাজীবনের শুরুটা হয় তার মায়ের হাতে। তার মায়ের হাতের লেখা ছিল এত সুন্দর যে, মনে হতো বইয়ের ছাপা অক্ষর কেউ তুলে এনেছে কাগজে। শুভ্রাংশুর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ শুরুতে খুব কম থাকলেও মায়ের ধৈর্য, ভালোবাসা এবং কঠোর পরিশ্রমে ধীরে ধীরে সে লেখাপড়ায় আগ্রহী হয়ে ওঠে।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে চকলেট আনতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় শুভ্রাংশু। তার পায়ে গুরুতর আঘাত লাগে, দীর্ঘ ছয় মাস স্কুলে যেতে পারে না। কিন্তু মা হার মানেননি। কোলে করে স্কুলে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিতে সাহায্য করেন। তার প্রচেষ্টাতেই শুভ্রাংশু প্রথম শ্রেণী শেষ করতে পারে।
পরিবারের আর্থিক সংকট চরমে, কিন্তু মায়ের স্বপ্ন স্পষ্ট—সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। সেলাই মেশিন চালিয়ে, আশপাশের স্কুলে প্রাইভেট পড়িয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাতে থাকেন তিনি। নিজের সব চাহিদা বিসর্জন দিয়ে সন্তানের সামান্য চাওয়া–পাওয়া পূরণ করতেন, যেন সে কখনো বুঝতে না পারে সংসারের কষ্ট।
যেখানে সাধারণত পিতারাই পরিবারের মূল দায়িত্ব নেন, সেখানে শুভ্রাংশুর মায়ের কাঁধেই ছিল পুরো পরিবারের ভার। সংসারের সব কাজ, দায়িত্ব, টানাপোড়েনের মাঝেও তিনি অবিচল ছিলেন। এমন মা-ই তো প্রকৃত কান্ডারি, যিনি ঝড়ের মুখেও নৌকো ডুবতে দেন না।
শুভ্রাংশুর পড়াশোনার যাত্রা সহজ ছিল না। অনেকেই বলতেন, “এই ছেলের দ্বারা কিছু হবে না।” কিন্তু মা বিশ্বাস হারাননি। তার নিরন্তর অনুপ্রেরণায় সে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়। এরপর আসে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পালা। এলাকার কলেজে পড়ার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখেন মা। যদিও প্রথমে ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয় শুভ্রাংশু, তবুও মায়ের ভরসা অটুট থাকে।
মা বলেন, “তুই পারবি, আমি জানি তুই পারবি।” সেই অনুপ্রেরণাতেই শুভ্রাংশু আবার প্রস্তুতি নেয়। পরীক্ষা দেয় এবং অবশেষে সে স্বপ্নপূরণ করে। একদিন সত্যিই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, হয়ে ওঠে একজন ‘পাবলিকিয়ান’।
আজ শুভ্রাংশুর জীবনে যতটুকু সফলতা, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান একটাই—তার মা। যদি মা না থাকতেন, তাহলে হয়তো এতদূর আসাই হত না। মায়ের ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও প্রেরণা–এই তিনটি শব্দই শুভ্রাংশুর জীবনের ভিত্তি।
শুভ্রাংশুর গল্প হাজারো মধ্যবিত্ত সন্তানের গল্পের প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি সন্তানের জীবনে তার মা-ই সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। মা–যিনি নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সন্তানের স্বপ্ন পূরণের পথ গড়ে দেন। শুভ্রাংশুর মা যেন বিশ্বের সকল মায়েদের প্রতিনিধি।
প্রার্থনা করি, পৃথিবীর প্রতিটি মা থাকুক সুস্থ, থাকুক ভালো, এবং প্রতিটি সন্তানের হৃদয়ে যেন তাদের জন্য থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।
(লেখক: শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস্ বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়)