প্রকৃতি, পরিবেশ অনেক সময় ঠিক করে দেয় মানুষের পেশা কী হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন অনেক পেশা তৈরি হয়। তারপর সেই পেশা রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে পরিবর্তন হয়ে এক সময় হারিয়ে যেতে থাকে। আশির দশকের কিছু নির্দিষ্ট পেশা নিয়ে এই আয়োজন, যে পেশাগুলো এখন আর নির্দিষ্ট পেশাজীবীদের হাতে নেই।
পাটনী বা খেয়াঘাটের মাঝি ওই সময়টাতে খাল-বিল এবং বিশেষ করে নদীতে বছরের প্রায় সাত-আট মাস পর্যন্ত পানি থাকতো। যার কারণে নদীর নির্দিষ্ট-নির্দিষ্ট পয়েন্টে খেয়া পারাপারের ব্যবস্থা ছিল। এই খেয়া পারাপারে যে লোকগুলো কাজ করতো তাদেরকে বলা হতো পাটনী। নদী যদি বড় হতো তাহলে বড় নৌকা আর ছোট হলে ছোট নৌকায় লোকজনকে তারা পার করতো। অপরিচিত যাত্রীদের কাছ থেকে এই পাটনীরা নগদ টাকা নিতো আর চেনা বা আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে বাৎসরিক হিসেবে ধান নিতো।
ভেসাল দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
জিনি বর্ষায় প্রচুর পানি হতো। জিনিরা বড় বড় জাল নিয়ে মাছ মারতো। দুইটা বাঁশ লাগিয়ে দিয়ে ওইটার মধ্যে পা লাগিয়ে জাল ওঠানো এবং পানিতে ফেলার ব্যবস্থা ছিলো। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ভেসাল। নদীতে, জলাশয়ের মুখে, যেখানে স্রোত যাচ্ছে, খালে, বর্ষার পানি আসার সময় যেখানে স্রোতটা আসে সেখানে ওই জাল ফেলা হতো।
মালি ও মালিনী এরা হলো নিম্নবর্ণের হিন্দু। এদের কাজ ছিল অপেক্ষাকৃত টাকা পয়সাওয়ালা লোকদের বিভিন্ন রকম পরিশ্রম সাধ্য বা কষ্টসাধ্য কাজগুলো করে দেওয়া। যেমন—গাছ কাটা, লাকরি চেরাই করা, বাড়িতে ঘর দেওয়ার সময় জোগালের বা সহকারীর কাজ করা। এ ছাড়া বাড়িতে মাটি ফেলা হলে সেই মাটি পিটিয়ে সমান করার মতো পরিশ্রমের কাজগুলো এই মালিরা করতো। এ ছাড়া মালিনীরা গেরস্থ বাড়ির নারীদের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতো। ঢেঁকিতে ধান ভানা, মুড়ি ভাজা, উঠান গোবর দিয়ে লেপা, মাটির ঘরের ডুয়া লেপা-পুচার কাজ তারা করতো। তখনকার দিনে ভারী কাপড়গুলো ক্ষারে দিয়ে ধোয়া হতো। অর্থাৎ সোডা দিয়ে পানি গরম করে গরম পানির মধ্যে কাঁথা, মশারি এগুলো সিদ্ধ করে ধোয়া হতো। এই কাজগুলো মালিরা করতো।
কুমোর কুমোররা বিভিন্ন ধরণের মাটির তৈজসপত্র তৈরি করতো । এবং সেগুলো ফেরি করে বিক্রি করতো বিভিন্ন জায়গায়। এরা আরেকটি কাজ করতো- কুয়ার পাত বা রিং তৈরি করতো। তখন টিউবয়েল সবার বাড়িতে ছিলো না। পাতকূয়ার খুব ব্যবহার ছিলো। এবং ওই সময় কুমোরেরা বাড়িতে এসে গর্ত করে পাত বসিয়ে কূয়া তৈরি করে দিতো। যেটা তখনকার দিনে সুপেয় জলাধারের অন্যতম একটি উৎস ছিলো। অনেক গেরহস্থ বাড়িতে টিউবয়েল ছিলো আবার পাতকূয়াও ছিলো।
মাঝি সে সময় জলপথে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য বড় বড় পাননি ও গয়না নৌকা থাকতো। এসব নৌকা চালাতেন মাঝিরা। এই পেশায়ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিন্দু নিম্ববর্ণের লোকজন নিয়োজিত ছিলেন। অল্প পরিসরে মুসলিম মাঝিও ছিল। তাদের কাজ ছিলো বড় নৌকা নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া। অনেক পয়সা ওয়ালা সম্ভ্রান্ত পরিবারের নিজস্ব মাঝি থাকতো। অনেক সময় মাঝিদেরই নিজেদেরই নৌকা থাকতো। এবং কেউ চাইলে সেটা ভাড়া নিতে পারতো।
ধারিয়া বা ধারওয়ালা তখনতো আজকের মতো গুঁড়া মসলার প্রচলন ছিলো না। যার ফলে সব বাড়িতেই শিলপাটা থাকতো। বছরে একবার-দুইবার এই শিলপাটা ধার কাটাতে হতো। ধার না কাটাইলে সমান হয়ে যেতো। সহজে মসলা পেষা যেত। ধারিয়া আসতো। তারা চোখে চশমা লাগিয়ে হাতুড়ি এবং বাটালির সাহায্যে পাটা ধারতো। অনেক সময় পাটার ওপরের দিকে মাছের ছবি এঁকে দিতো। বা অনেক সময় ফুলের ছবি এঁকে দিত।
গোয়াল এরা যশোর এলাকা থেকে আসতো। গরুর যে খোড়া রোগ হতো, সেই রোগের চিকিৎসা করতো। আবার গরুর জিহ্বা পরিষ্কারের কাজও করতো। গরুর জিহ্বায় ময়লার স্তর পড়ে গেলে গরুর খাওয়ার রুচি কমে যেত, দেখা যেত যে জিহ্বা পরিষ্কার করলে গরু আগ্রহ নিয়ে খাওয়া শুরু করতো। এজন্য গোয়ালকে দিয়ে গরুর জিহ্বা পরিষ্কার করানো হতো। গোয়ালরা আরও নানান রকমের কাজ করতো । এবং এরা খুব জোরে জোরে ডাক দিতো, সেজন্য আগের দিনে কেউ জোরে কথা বললে, বাড়ির বড়রা বলতো ‘গোয়ালের মতো করছিস কেন?’। এই গোয়ালেরা খুব ধুপদূরস্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতো। এদের সাথে প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস থাকতো। অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য যা যা লাগবে তা তারা সঙ্গে রাখতো। বিভিন্ন বাড়ির কাছারি ঘর যেটা থাকতো সেখানে বলে কয়েই থাকতো, যে আজকে আপনার এখানে থাকবো। অথবা তারা কোনো ক্লাবে বা স্কুলের বারান্দায় থাকতো। এবং তারা অনেক সময় দলবদ্ধভাবেও থাকতো। দিনে ছড়িয়ে পড়তো আবার রাতে হয়তো এক জায়গায় থাকতো। এদের সাথে রান্নার হাঁড়ি, কাপড়- চোপড়, ছালার ব্যাগ আর একটি লাঠি থাকতো। লাঠির পেছনে ঝোলানো থাকতো ব্যাগ। এরা এভাবে এসে গরুর চিকিৎসা করে যেত।