গুরুতর অপরাধ মামলায় আটক বা গ্রেপ্তার হলেই অপসারণ করা যাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মন্ত্রীদের। তাদের দোষী সাব্যস্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। বুধবার নতুন এই বিল এনেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। বুধবার দেশটির সংসদে পেশ হয় এই বিল। বিলটিকে “একটি বিপজ্জনক ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ” বলে আখ্যা দিয়ে সংসদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন বিরোধীরা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি বর্তমানে এমন কোনো আইন নেই যেখানে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে নেতানেত্রীদের তাদের পদ থেকে অপসারণ করা যেতে পারে। এই ত্রুটিগুলো দূর করতেই নতুন এই তিনটি বিল কেন্দ্রের, যা গুরুতর ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
বুধবার কেন্দ্র যে তিনটি সংশোধনী বিল পেশ করেছে তার মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সরকার (সংশোধন) বিল ২০২৫, সংবিধান (১৩০তম সংশোধন) বিল ২০২৫ এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন (সংশোধন) বিল ২০২৫। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দপ্তর থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেই চিঠি পাঠানো হয় লোকসভার সাধারণ সচিবকে।
সংবিধানের ১৩০তম সংশোধনের কথা উল্লেখ করে নতুন বিলে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের কোনো মন্ত্রী যদি গ্রেপ্তার হন এবং একটানা ৩০ দিন হেফাজতে থাকেন, ৩১তম দিনে তাকে হয় পদত্যাগ করতে হবে, নয়ত পদ থেকে সরানো হবে।
বিলে গুরুতর অপরাধ বলতে কী ধরনের ফৌজদারি অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে অনুমান করা হচ্ছে, যে অপরাধে অন্তত পাঁচ বছর বা তার বেশি কারাবাস হতে পারে, এখানে তেমন মামলার কথাই বলা হচ্ছে। খুন থেকে বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে ধরা হতে পারে।
নতুন বিল অনুযায়ী, কোনো রাজ্যের রাজ্যপাল বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট গভর্নরই নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে পদ থেকে সরাতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীকে সরানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে থাকা কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী সংস্থা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটানা ৩০ দিন জেলে রাখবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
এতদিন পর্যন্ত কোনো মামলায় দোষী সাব্যস্ত জনপ্রতিনিধিকেই অপসারণের নিয়ম ছিল। মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই পদত্যাগ করতে হতো, যাতে সরকারের কাজকর্মে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। দিল্লির আবগারি দুর্নীতি মামলায় অরবিন্দ কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও ছয় মাস জেল থেকেই সরকার চালিয়ে যান। নতুন নিয়ম আনতে গেলে তাই সংবিধানের ৭৫, ১৬৪ এবং ২৩৯এএ ধারাও সংশোধন করতে হবে।
বুধবার সকালে অধিবেশনের আগে বিরোধী দলগুলো বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি বৈঠক করে। সেখানেও তারা বিলটিকে ‘কঠোর’ এবং ‘অসাংবিধানিক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং ভোটারদের সতর্ক করেছেন যে বিজেপি দেশকে ‘পুলিশ রাষ্ট্র... একনায়কতন্ত্র’তে পরিণত করার চেষ্টা করছে।
বিরোধী দলগুলো মনে করছে, এই বিল কার্যকর হলে কেন্দ্র সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলার ভিত্তিতে তাদের জেলে পাঠিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদচ্যুত করতে পারবে। এর ফলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতৃত্বকে বিচার ছাড়াই সরিয়ে দেওয়া যাবে, যা ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোর সম্পূর্ণ বিরোধী।
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রা এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমি একে সম্পূর্ণরূপে স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলে মনে করি। এটিকে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দেওয়া আসলে জনগণের চোখে ধুলো দেওয়া। কালকেই যদি কোনো বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা মামলা করে তাকে ৩০ দিনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে কি তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদ হারাবেন? এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বিরুদ্ধে।”
অন্যদিকে বিশিষ্ট আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি বলেন, “বিজেপি বুঝতে পেরেছে তারা ভোটে হারতে বসেছে, তাই এখন বিরোধী সরকারগুলোকে ভেঙে ফেলার জন্য আইনি হাতিয়ার বানাতে চাইছে। তারা কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে দিয়ে বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করাবে, আর এই বিল কার্যকর হলে সেই নেতাদের বিচার না-হতেই পদচ্যুত করে দেবে।”
বিরোধীরা এই প্রস্তাবিত বিলকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উদাহরণ টানেন। তিনি ২০২৪ সালের মার্চ মাসে কথিত মদ দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হন এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত পাঁচ মাসেরও বেশি সময় জেলবন্দি ছিলেন। যদিও তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো দোষ প্রমাণ হয়নি, বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি, তবুও বিজেপি ও তার মিত্ররা তার পদত্যাগ দাবি করে। কেজরিওয়াল সেই সময় বলেছিলেন, “আমি এখনো দোষী সাব্যস্ত হইনি, আমার বিচার পর্যন্ত হয়নি, তাহলে কেন আমি পদত্যাগ করব?”
যদি এই প্রস্তাবিত আইন তখন কার্যকর থাকত, তবে ৩০ দিন পূর্ণ হতেই তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অপসারিত করা হতো।
একই রকম ঘটনা ঘটেছে তামিলনাড়ুতেও, যেখানে ডিএমকে নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী ভি সেন্টিল বালাজিকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন তাকে মন্ত্রী হিসেবে বহাল রাখলেও তার দপ্তর ছিনিয়ে নেওয়া হয়। রাজ্যপাল আর এন রবি এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করলে তা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। পরে চাপের মুখে বালাজি পদত্যাগ করেন।
বিভিন্ন বিরোধী দল একযোগে এই বিলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। আরএসপি’র সংসদ সদস্য এন কে প্রেমচন্দ্রন বলেন, “এই বিলের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট – বিজেপি বিরোধী দলগুলোর সরকার ভেঙে দিতে চাইছে। কেন্দ্র সরকারের অধীনে থাকা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে তারা বিরোধীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলা করছে। এখন সেই অবৈধ কাজকে আইনি বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।”
এআইএমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েইসি আরো কঠোর ভাষায় বলেন, “বিজেপি আমাদের দেশকে পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে। তারা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করছে, যেখানে বিরোধী নেতারা হয় জেলে থাকে না হয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্র এত সহজে ভাঙবে না। আমরা এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করব।”
আরজেডি নেতা সুধাকর সিং বলেন, “এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য এক বিপজ্জনক মোড়। আজ বিরোধী নেতাদের জেলে পাঠিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা চলছে, কাল দেশের বাকস্বাধীনতা ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।”
অন্যদিকে বিজেপির দাবি, এই বিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর পদক্ষেপ। তারা বলছে, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তরা যাতে ক্ষমতায় থেকে প্রমাণ লোপাট বা প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সেই লক্ষ্যে এই আইন প্রয়োজনীয়।
বিজেপির কর্নাটকের বিধায়ক অরবিন্দ বেল্লাড বলেন, “বিগত সময়ে অনেক মুখ্যমন্ত্রী জেলে থেকেও সরকার চালানোর চেষ্টা করেছেন। এমন পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে শক্তিশালী আইন দরকার। এই বিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতির প্রতিফলন।”
বর্তমানে ভারতের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্য বা বিধায়ক যদি এমন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন যার শাস্তি কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ড, তবে তিনি তার পদ হারান। কিন্তু বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার পদে থাকা নিয়ে কোনো বাধা নেই।