সারা বাংলা

কালীগঙ্গায় নৌকাবাইচ, দর্শকের ঢল

মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা বেউথা নদীর পাড়ে যেন উৎসবের আবহ। নৌকাবাইচ উপলক্ষে সকাল থেকেই নদীর দুই তীরে জড়ো হতে থাকে মানুষ। নৌকাবাইচ এ এলাকার মানুষের তীব্র ভালোবাসার অপর নাম সেটা দর্শকের ঢল দেখলেই বোঝা যায়। নদীর বুকে ঢাক-ঢোলের তালে নৌকার মিছিল যেন দর্শকের রক্তে উত্তেজনার বাণ ডেকেছে। কারো কাছে এটি শুধু খেলা নয়, বরং গ্রামীণ ঐতিহ্যের এক বর্ণময় উৎসব।

শনিবার (২৩ আগস্ট) দুপুরে ‘নদী দূষণ রোধ করি, নির্মল বাংলাদেশ গড়ি’ প্রতিপাদ্যে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এ নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। 

এসময় জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা, পুলিশ সুপার মোছা. ইয়াসমিন খাতুন, মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আফরোজা খানম রিতা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমতিয়াজ মাহবুব‌ উপস্থিত ছিলেন। 

নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় অর্ধশতাধিক বাইচের নৌকা অংশ নেয়। প্রতিটি নৌকায় মাঝিদের প্রাণপণ বৈঠা চালনার পারদর্শিতা। কারও মুখে ঘাম ঝরে, কারও গলায় স্লোগান- ‘হই-হই হইয়া’ ও ‘আল্লাহ নাম লইয়া-চালাও বৈঠা ভাইয়া’ সব মিলিয়ে কালীগঙ্গা নদীর বুক যেন কেঁপে ওঠে বৈঠার আঘাতে। প্রতিযোগিতা শেষে বাইচ বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অতিথিরা। 

কয়েক দিন ধরেই চারপাশের গ্রামে ছিলো আলোচনা শনিবার কালীগঙ্গায় বাইচ হবে। এদিন সকাল থেকে নদীর ঘাটগুলোতে ঢল নামে গ্রামবাসীর। কেউ হাতে পতাকা, কাউকে আবার শিশুদের কাঁধে বসিয়ে দৌড়ে নদীর ধারে যেতে দেখা যায়। 

তীব্র গতি তুলে অন্যদের পিছনে ফেলে যেন এগিয়ে যাওয়ার যুদ্ধে নেমেছেন বাইচের মাঝিরা।

এদিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে বাইচের নৌকাগুলো এসে পৌঁছায় নদীর পাড়ে। লম্বা সরু নৌকায় সাজানো বৈঠা, মাথায় বাঁধা রঙিন ফিতা, আর গলার স্বরে উচ্চারণ করা স্লোগান যেন প্রতিযোগিতার আগেই পরিবেশে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।

প্রতিযোগিতা ঘিরে নদীর পাড়ে বসে ছোটখাটো মেলা। শিশুদের জন্য বেলুন, খেলনা, নারকেল ভাজা, জিলাপি—সব মিলিয়ে এক ভিন্ন রকম উৎসবের আমেজ। স্থানীয় তরুণরা মোবাইল ক্যামেরায় ধরে রাখছে বাইচের দৃশ্য, বৃদ্ধরা চুপচাপ বসে নিজেদের শৈশবের নৌকাবাইচের দিনগুলোর কথা মনে করছেন।

দর্শক লোকমান হোসেন বলেন, “ছোটকালে বাপের লগে বাইচ দেখবার আইতাম। এহন পোলারে নিয়া আইছি। নৌকা বাইচে আইসা ছোটকালের কথা মনে পইড়া যাইতেছে। কত খেল্লা কিনতাম, বেহাতি কিনতাম।” 

স্থানীয় বাসিন্দা মাসুদ পারভেজ বলেন, “গ্রামীণ বাংলার সামাজিক সংস্কৃতি ও উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ নৌকাবাইচ। বর্ষার মৌসুমে কিংবা বিশেষ উৎসবে এ খেলা মানুষকে একত্রিত করে, বাড়ায় মিলনমেলা। তাই কালীগঙ্গার এই আয়োজন কেবল একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং স্থানীয় মানুষের জন্য আনন্দ, ঐতিহ্য আর গর্বের বিষয়।”

অংশগ্রহণকারী মাঝি আনোয়ার হোসেনের শরীর বেয়ে তখনও ঘাম ঝরছে। তিনি বলেন, “এই নৌকা বাইচ শুধু প্রতিযোগিতা না, আমাদের আবেগ। বৈঠা চালানোর সময় মনে হয় নদী আমাদের সাথে কথা বলছে।”

নদীর বুকে বৈঠার তীব্র আঘাত হেনে এগিয়ে চলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা।

স্থানীয় প্রবীণরা জানান, একসময় বর্ষাকালে নিয়মিত নৌকা বাইচ হতো। আজকের আয়োজন তাদের পুরনো দিনের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে। কালীগঙ্গার বুকে আজকের বৈঠার ছন্দ যেন প্রমাণ করল গ্রামীণ ঐতিহ্য এখনও বেঁচে আছে, শুধু তাকে নিয়মিতভাবে তুলে ধরার প্রয়োজন।

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক (যুগ্ম সচিব) ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “নদীমাতৃক বাংলার সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে এ আয়োজন করা হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে আনন্দ-উৎসবে একত্রিত করা এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে নৌকাবাইচের ঐতিহ্য তুলে ধরা এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।”

বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, “গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং নদীমাতৃক সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। আমরা চাই, এ ধরনের উৎসব মানুষের মাঝে সম্প্রীতি ও আনন্দ ছড়িয়ে দিক।”