বরগুনায় নদীর জোয়ার-ভাটার স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন এক উদ্ভাবক। তার উদ্ভাবনকৃত বিদ্যুতে একসঙ্গে জ্বলছে অর্ধশতাধিক বৈদ্যুতিক লাইট। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকলেও এমন উদ্ভাবন করেছেন বরগুনা সদর উপজেলার পুরাকাটা গ্রামের মনিরুল ইসলাম।
সরেজমিনে দেখা যায়, পায়রা নদীর একটি খালে স্লুইচ গেট দিয়ে পানি প্রবেশের মুখে নিজের উদ্ভাবিত বিশেষ যন্ত্র বসিয়েছেন মনিরুল। যা জোয়ার-ভাটার স্রোতের ধাক্কায় ঘুরে বিদ্যুৎ তৈরি করছে। প্রাকৃতিক শক্তিকে হাতের মুঠোয় এনে আলোর উৎস ছড়িয়ে দেওয়ার অনন্য এ সফল উদ্ভাবনে আনন্দিত এলাকাবাসী।
শনিবার (২৩ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টার দিকে পায়রা নদীতে জোয়ার শুরু হয়। জোয়ারের স্রোতকে কাজে লাগিয়ে এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে তিনি ৫০টি টিউবলাইট জ্বালিয়েছেন।
জানা যায়, মনির স্থানীয় একটি বাজারে জ্বালানি তেলের ব্যবসা করেন। ২০০৬ সালে ব্যবসার পাশাপাশি প্রাকৃতিক শক্তিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনমূলক গবেষণা শুরু করেন। অদম্য মনোবল নিয়ে তিন মাসের চেষ্টায় মাত্র ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে কিছু যন্ত্রাংশ কিনে উদ্ভাবন করেন অভিনব এই যন্ত্র। পরে পায়রা নদীর একটি খালের স্লুইস গেটে সেগুলো স্থাপন করেন। আর তখন থেকে জোয়ার-ভাটার স্রোতের মাধ্যমে সফলভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছেন তিনি।
মনিরুলের প্রতিবেশী সোহরাব হোসেন বলেন, ‘‘প্রথমে মনিরকে দেখে সবাই হাসাহাসি করেছে। এখন সবাই প্রশংসা করছে। আমরা সত্যিই অবাক হয়েছি। কোনো ধরনের শিক্ষা কিংবা অভিজ্ঞতা না থাকলেও নিজেই প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছেন।’’
স্থানীয়রা জানান, ছোট থেকে মনিরুলের বিদ্যুতের বিষয়ে আগ্রহ ছিল। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় তেমন কিছু করতে পারেনি। এখন জোয়ার-ভাটার স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মনিরের উদ্ভাবনী যন্ত্রের মাধ্যমে জ্বালানি ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে।
মনিরুলের স্ত্রী তাসলিমা বেগম বলেন, ‘‘জোয়ার-ভাটার পানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব তা কখনো ভাবতে পারিনি। তবে, আমার স্বামী দীর্ঘদিনের চেষ্টায় সফল হয়েছেন।’’
জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘সফলতার গল্প এখনো শুরু হয়নি। এটা কেবল শুরু। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা চালিয়েছি। তিন মাসের চেষ্টায় নদীর জোয়ার-ভাটাকে ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সফল হয়েছি। ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ করে লোহার অ্যাঙ্গেল ও লোহার প্লেট দিয়ে একটি ফ্যান এবং স্ট্রাকচার তৈরি করেছি। পানির চাপে ওই ফ্যান ঘুরলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারের সহযোগিতা পেলে দেশের উপকূলীয় এলাকায় এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। আমার প্রকল্পটি যদি যুক্তিসঙ্গত এবং বিজ্ঞানসম্মত হয় তাহলে চাইলেই জ্বালানি ছাড়া জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে আলোকিত করা সম্ভব। দিনে দুই বার জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায়। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে।’’
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বরিশাল জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ‘‘প্রাকৃতিকভাবে সৌর, বায়ু এবং পানির শক্তিকে ব্যবহার উপযোগী করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তাহলে জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা কমিয়ে এনেছে। আমাদের দেশেও প্রাকৃতিক যেসব উৎস আছে সেগুলোকে কাজে লাগাতে সরকারের দিক থেকেও পরিকল্পনা রয়েছে। মনিরুল ইসলামের বিষয়টি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জেনেছি। সরকার চাইলে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারে।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘ছোট পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন এক না।’’
বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইয়াছির আরাফাত রানা বলেন, ‘‘মনিরুল ইসলামের বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি জানতে পেরে তার সঙ্গে দেখা করেছি। বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।’’