সারা বাংলা

মানিকগঞ্জে সবজি সংরক্ষণে নতুন সংযুক্তি

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের মেদুলিয়া গ্রাম। দুপুরের গরম সহ্য করে এই গ্রামে উপস্থিত ছিলেন আশপাশের বিভিন্ন এলাকার কৃষক। তাদের কেউ টমেটো, আবার কেউ ঝুড়িতে ফুলকপি নিয়ে এসেছিলেন। কারো মুখে ছিল না ক্লান্তি। কারণ তারা জানেন, এবার আর তাদের ফসল মাঠে পচে নষ্ট হবে না। গ্রামে এসেছে নতুন আশার আলো; ফারমার্স মিনি কোল্ড স্টোরেজ। ঘাম ঝরানো পরিশ্রম আর নতুন প্রযুক্তির মেলবন্ধনে বদলে যাবে গ্রামীণ অর্থনীতি এমনটাই আশা তাদের। 

চাষিরা এতদিন প্রচুর ফসল ফলালেও বিপাকে পড়তেন বিক্রির সময়। মৌসুমে বাজার ভরে যেত সবজিতে, দাম পড়ত মাটিতে। লোকসানের দুঃখ নিয়ে কৃষক ঘরে ফিরতেন। অনেক সময় বিক্রি করতে না পারায় নিজেদের উৎপাদিত টমেটো বা ফুলকপি মাটিতেই পুঁতে ফেলতে হতো চাষিদের।

সেই দুঃখের কথা মনে করে কৃষক আব্দুল করিম বলেন, “গত শীতে এত টমেটো উঠেছিল যে, বাজারে দামই ছিল না। বাধ্য হয়ে ফসল নষ্ট করেছি। এখন যদি কোল্ড স্টোরেজে রাখতে পারি, মৌসুম শেষে ভালো দামে বিক্রি করতে পারব। এটাই আমাদের বাঁচাবে।”

ফারমার্স মিনি কোল্ড স্টোরেজ নিয়ে পুরুষদের পাশাপাশি নারী কৃষকরাও ছিলেন সমান উচ্ছ্বসিত। শামীমা বেগম বলেন, “আমাদের এলাকায় মেয়েরা অনেক সবজি চাষ করে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় সব নষ্ট হয়ে যেত। এখন আমরা নিজেরাই দাম ঠিক করতে পারব। এই কোল্ড স্টোরেজ আমাদের জন্য আশীর্বাদ।”

বুধবার দুপুরে কোল্ড স্টোরেজ উদ্বোধন করেন কৃষি উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী 

কৃষক রহিম মিয়া এই কোল্ড স্টোরেজ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, “দাম পড়ে গেলে আমরা সবজি সংরক্ষণ করব। যখন চাহিদা বাড়বে, তখন বিক্রি করব। আমাদের আর লোকসান গুনতে হবে না।”

কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ আর জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে চালু হওয়া এই প্রকল্পের নাম—‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সাশ্রয়ী কোল্ড স্টোরেজ সম্প্রসারণ’। ছোট আকারের এই হিমাগারই বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ধাপে ধাপে সারা দেশে এমন ১০০টি কোল্ড স্টোরেজ দেওয়া হবে কৃষকদের সংগঠনের হাতে।

এই কোল্ড স্টোরেজের দুটি ধরণ রয়েছে—ঘরভিত্তিক ও কনটেইনারভিত্তিক। দুইটি সৌরশক্তি চালিত, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। বিশেষ সেন্সরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, যা মোবাইল অ্যাপ থেকেই পরিচালনা সম্ভব। ৫ লাখ টাকায় তৈরি ঘরোয়া কোল্ড স্টোরেজে রাখা যাবে ১০ টন পণ্য, আর কনটেইনারভিত্তিক সংস্করণের খরচ ১৫ লাখ টাকা। প্রচলিত বড় কোল্ড স্টোরেজের তুলনায় খরচ প্রায় ৭০ শতাংশ কম।

এই প্রযুক্তি শুধু কৃষকের আয় বাড়াবে না, পরিবেশ রক্ষাতেও বড় ভূমিকা রাখবে। একেকটি সৌরচালিত মিনি কোল্ড স্টোরেজ বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কেজি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ রোধ করে যা ১৪০–১৬০টি পূর্ণবয়স্ক গাছের সমান কাজ করে।

বুধবার (২৭ আগস্ট) দুপুরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রকল্প পরিচালক তালহা জুবায়ের বলেন, “এটি পুরোপুরি কৃষকবান্ধব প্রযুক্তি। আমাদের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ইন্টারনেটভিত্তিক মনিটরিং থাকায় ঘরে বসেই মোবাইল ফোন দিয়ে হিমাগার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।”

কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানও আশাবাদী। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ফসল উৎপাদনে এগিয়ে থাকলেও সংরক্ষণে পিছিয়ে। এই উদ্যোগ কৃষকদের জন্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে। ধাপে ধাপে গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে যাবে এই প্রযুক্তি।”

কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “ফারমার্স মিনি কোল্ড স্টোরেজ কৃষকের বহু বছরের কষ্ট ঘোচাবে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও আধুনিক এই প্রযুক্তি কৃষিকে এগিয়ে নেবে বহুদূর।”