দীর্ঘ ৯ বছর ছেলের ফিরে আসার অপেক্ষায় চোখের পানি ফেলছেন গুমের শিকার সাতক্ষীরার হোমিও চিকিৎসক মোখলেসুর রহমান জনির বৃদ্ধ বাবা শেখ আব্দুর রাশেদ। কাঁদতে কাঁদতে অপেক্ষারত বাবার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করতে আদালতে ছোটাছুটি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। কিন্তু কোথাও আশার আলো দেখছেন না। ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তিনি ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন।
শনিবার (৩০ আগস্ট) সকাল ১০টায় ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষ্যে খুলনায় মানববন্ধন ও র্যালিতে অংশ নিয়ে শেখ আব্দুর রাশেদ এ দাবি জানান। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ নগরীর পিকচার প্যালেস মোড়ে এ মানববন্ধনের আয়োজন করে। এর আগে খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে একটি র্যালী বের হয়ে পিকচার প্যালেস মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।
শেখ আব্দুর রাশেদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘‘২০১৬ সালের ৪ আগস্ট সাতক্ষীরা সদর থানার এসআই হিমেলের নেতৃত্বে পুলিশ জনিকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এরপর প্রায় ৯ বছরেও তার সন্ধান দিতে পারেনি পুলিশ। ছেলেকে হারিয়ে সংসার তছনছ হয়ে গেছে। জনির মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’’
অভিযুক্ত সাতক্ষীরা সদর থানার তৎকালীন ওসি এমদাদ হোসেন ও এসআই হিমেলসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের কঠোর শাস্তি এবং জনিকে ফিরিয়ে দিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন শেখ আব্দুর রাশেদ।
মানববন্ধনে অন্যান্যরা বলেন, ‘‘গুম মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার। স্বাধীন দেশে এমন কথা ছিল না যে, গুমের বিরুদ্ধে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে হবে, জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। একইসঙ্গে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’’
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব ও পরিচালনা করেন অধিকার খুলনার ফোকাল পার্সন সাংবাদিক মুহাম্মদ নূরুজ্জামান। দিবসের বিবৃতি পাঠ করেন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী কেএম জিয়াউস সাদাত।
মানববন্ধন থেকে দিবসের বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়, অধিকার দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ‘গুম হওয়া থেকে সমস্ত ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ’ অনুমোদনের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট অন্তর্র্বতীকালীন সরকার এই সনদ অনুমোদন করে। গুম একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কর্তৃত্ববাদী সরকার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে গুমকে ব্যবহার করেছে।
অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কাছে অধিকারের পক্ষ থেকে ৬টি দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে: গুমের শিকার যেসব ব্যক্তি ফেরত আসেননি তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জনগণকে জানাতে হবে, যেসব গুমের শিকার ব্যক্তি এখনও ফিরে আসেননি, তাদের স্ত্রী-সন্তানরা যেন গুম হওয়া ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব পরিচালনা ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ভোগ বা বিক্রি করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে, গুমের পর কিছু ব্যক্তিকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং পরে তাদের পাওয়া গেছে। তাই ভারতে এখনো গুমের শিকার কেউ আটক আছেন কি না সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে, গুম থেকে ফিরে আসা অনেক ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। কারও ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য বা নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করে নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এসব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং ভুক্তভোগীদের কারাগার থেকে মুক্তি দিতে হবে। গুমের সঙ্গে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করতে হবে এবং গুম প্রতিরোধে দ্রুত আইন প্রণয়ন করতে হবে।
কর্মসূচিতে বক্তৃতা করেন খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নুরুল হাসান রুবা, খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নাগরিক ঐক্যের খুলনা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক কাজী মোতাহার রহমান বাবু, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহকারী মহাসচিব এহতেশামুল হক শাওন, বিএফইউজের সাবেক সহ-সভাপতি মো. রাশিদুল ইসলাম, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) খুলনার সংগঠক আহম্মদ হামিম রাহাত ও গুমের শিকার পাটকল শ্রমিক নেতা মো. ওলিয়ার রহমান প্রমুখ।