কৃষি

বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহে রেকর্ড

দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ঘোষিত অভ্যন্তরীণ বোরো সংগ্রহ কর্মসূচি-২০২৫-এ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান ও চাল সংগৃহীত হয়েছে।

গত ১৫ আগস্ট সমাপ্ত বোরো সংগ্রহ অভিযানে সরকারি লক্ষ্য ১৮ লাখ মেট্রিক টনের বিপরীতে ৩ লাখ ৭৬,৯৪২ মেট্রিক টন ধান, ১৪ লাখ ৬৫৩৩ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল এবং ৫১,৩০৭ মেট্রিক টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। এর ফলে সমগ্র সংগ্রহ দাঁড়িয়েছে ১,৮৩৪,৭৮২ মেট্রিক টন, যা লক্ষ্য অতিক্রম করেছে।

সরকারি বোরো সংগ্রহের জন্য ধান, সিদ্ধ চাল ও আতপ চালের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল যথাক্রমে ৩,৫০,০০০ও ১৪,০০,০০০ এবং ৫০,০০০ মেট্রিক টন। শেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী: ধান: ৩৭৬,৯৪২ মেট্রিক টন, সিদ্ধ চাল: ১,৪০৬,৫৩৩ মেট্রিক টন আতপ চাল: ৫১,৩০৭ মেট্রিক টন।

কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী প্রথমত, অভ্যন্তরীণ সংরক্ষণ বাজার স্থিতিশীল রাখে। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, সরকারের হাতে যত বেশি মজুত থাকবে, তারা তত বেশি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ওএমএস এবং অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এর ফলে দর নিয়ন্ত্রণে সহায়তা হয়, এবং দরপতন বা মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা সহজ হয়।

দ্বিতীয়ত, সময়মতো সংগ্রহ আমদানির চাপ কমায়। বিদেশ থেকে অতিরিক্ত আমদানির প্রয়োজন না হওয়ায় বড় অর্থনৈতিক ব্যয়ও কমে। বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের কারণে সরকারকে এবার প্রচুর আমদানি নির্ভর হতে হয়নি।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি সংগ্রহ কেন্দ্রে নির্ধারিত মূল্য মেনে কৃষকরা তাদের ধান-চাল বিক্রি করেছেন। ফলে বাজার দরে বিক্রি করার ঝুঁকি কমেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা এ এম ইমদাদুল ইসলাম বলেন, “সরকারি সংগ্রহ অভিযানে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পেয়েছেন এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে সংগ্রহ সম্পন্ন হয়েছে। এই সাফল্যের ফলে খাদ্য মজুত আরো শক্তিশালী হয়েছে।

জেলা ও বিভাগওয়ারী সংগ্রহের চিত্র সরকারি বোরো সংগ্রহ শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নয়, জেলা ও বিভাগওয়ারী লক্ষ্যও অতিক্রম করেছে। রাজশাহী বিভাগ: ধান সংগ্রহের হার ১০৪–১৯৪%, সিদ্ধ চাল ৯৪–৯৯%, মোট ১২৯% অর্জন। রংপুর বিভাগ: ধান ১০০–১৫৩%, সিদ্ধ চাল ৯৭–১১৯%, মোট ১০৬% অর্জন।

খুলনা বিভাগ: ধান ৮৫–১২৩%, সিদ্ধ চাল ১০০–১০৫%, মোট ১০৬% অর্জন। বরিশাল বিভাগ: ধান ১০০–৩৪৩%, সিদ্ধ চাল ১০২–১৫৯%, মোট ১০৬% অর্জন। সিলেট বিভাগ: ধান ১০৩–১৪০%, সিদ্ধ চাল ১০০–১১৬%, আতপ চাল ১০৬–১৫১%, মোট ১৫১% অর্জন।

ঢাকা বিভাগ: ধান ১৭–১০৭%, সিদ্ধ চাল ৯৪–১০০%, মোট ৯৬% অর্জন। ময়মনসিংহ বিভাগ: ধান ৯১–৯৬%, সিদ্ধ চাল ৯৭–১০৩%, মোট ৯৭% অর্জন।

চট্টগ্রাম বিভাগ: ধান ৫৯–৮৫%, সিদ্ধ চাল ১০০–১৩০%, আতপ চাল ৯৭–১১৬%, মোট ১৩৯% অর্জন। এই জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, সংগ্রহের কার্যক্রম সব বিভাগে লক্ষ্যমাত্রার সমান বা তার চেয়ে বেশি।

বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বিতরণ সরকারি মজুতগুলি ওএমএস, সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প এবং জরুরি পরিস্থিতিতে রেশন বিতরণের জন্য ব্যবহার করা হবে। এর মাধ্যমে বাজারে দরবৃদ্ধি রোধ, নিম্ন আয়ের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ক্রয়মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সংগ্রহকৃত চাল-ধানের মান ও সরবরাহ চেইন নিশ্চিত করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ ও সতর্কবার্তা যদিও সংগ্রহ সফল হয়েছে, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। গুদাম ব্যবস্থাপনা ও ভান্ডার রক্ষণাবেক্ষণ সঠিক না হলে দীর্ঘমেয়াদে লোকসান হতে পারে। অতিরিক্ত সরবরাহ করলে ক্ষুদ্র চাষী বা ব্যবসায়ীর আয় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাজারে দর নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থির নীতি ও স্বচ্ছ সময়সূচি অপরিহার্য।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, “খাদ্য মন্ত্রণালয় পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাবে। মজুতে থাকা চাল-চালান নিয়মিত যাচাই করা হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং টার্গেট বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি কৃষক সচেতনতা, সার-বীজ সরবরাহ ও কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হবে।”

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা এ এম ইমদাদুল ইসলাম বলেন, “বোরো মৌসুমে সময়মতো ও লক্ষ্যমাত্রার উপরে সরকারি সংগ্রহ দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে শক্ত করতে সহায়ক। কৃষক, নীতিনির্ধারক ও বাজার-অভিযন্ত্ররা মিলে যদি মজুতের মান রক্ষা, কার্যকর বিতরণ ও স্বচ্ছ বাজার নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে সামনের সময়ে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়পক্ষেই উপকার হবে। সরকারি বোরো সংগ্রহ অভিযান ২০২৫-এর এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, সময়মতো অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও বাজার নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা সম্ভব। এবার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এই মজুতকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে দর নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকের মুনাফা নিশ্চিত করা।”

খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “সারা দেশে সামগ্রিকভাবে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য মজুত রয়েছে। আমরা পোর্টেবল অবস্থায় আছি।”