সন্ধ্যা হয়ে গেছে। জয়তুন বিবি অন্ধকারের মধ্যে ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। তার কুপি জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না। ইদানীং শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। ছেলেটাকে বিয়ে দিয়ে ভেবেছিল বাকি জীবনটা নিরিবিলি কাটিয়ে দেবে। কিন্তু তার মনের কথা শুনে অলক্ষ্যে বসে বিধাতা হয়তো মুচকি হেসেছেন। জয়তুন বিবি বাজারে ধান ভাঙ্গানোর মিলে কাজ করে। ইদানীং কাজের চাপ অনেক কম। কারণ শহরে সব অত্যাধুনিক মেশিন আছে। ধান উঠলেই ব্যাপারীরা গ্রামের বাজার থুয়ে শহরের দিকে ছোটে। জয়তুন বিবিরও বয়স হয়েছে, সে আর আগের মতো খাটতে পারে না। তাছাড়া নানান রকম রোগ, শোক তো আছেই। এসব কারণে প্রায় দিনই তার কাজে ডাক পড়ে না। এদিকে সুদের কিস্তি ঠিকমতো পরিশোধ করে যেতে হয়। এসব দুশ্চিন্তা তাকে আরও বিষণ্ণ করে রাখে। অথচ তার জীবনটা এমন ছিল না। খুব ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর স্বামীর দু’হাত ভরে টাকা আসতে শুরু করল। এই স্রোতের মতো টাকা আসাটাই কাল হলো তার। ওই যে, কথায় বলে, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎসঙ্গে সর্বনাশ! কথাটা স্বামীর স্বভাব এবং জীবনের সঙ্গে মিলে গেল। দিনের পর দিন স্বামীর অত্যাচার, অবহেলা, অপমানে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল জয়তুন বিবির বিবাহিত জীবন। এক সময় ছেলেমেয়ে নিয়ে তার আর স্বামীর সংসারে থাকা সম্ভব হলো না। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে জয়তুন বিবি চলে এলো। আসলে চলে এলো না বলে বলা উচিত রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে এলো অজানা সুখ আর একটু স্বাধীনতার খোঁজে। তারপর একরকম ঘুরতে ঘুরতে এসে ভিড়ল এই গ্রামে। সামান্য যা কিছু ছিল তাই দিয়েই তুলল একটি ছোট্ট ঘর-তার স্বপ্নের মাথা গোজার ঠাঁই। মুরগি যেভাবে দুই পাখনার ভেতর বাচ্চাগুলোকে আগলে রাখে জয়তুন বিবিও সেভাবেই ছেলেমেয়ে দুটিকে আগলে রেখে নূতন জীবন শুরু করলো। দিনের পর দিন গেল, রাত এলো, আবার দিন। এভাবেই জীবনের পথে জীবন চলতে লাগল তার মতো। একদিন মেয়েটারও বিয়ে হলো, ছেলেটাও ততদিনে শহরের একটা মিলে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। এবার ছেলের বিয়ের জন্য জয়তুন বিবি উতালা হয়ে উঠল। এ-গ্রাম, ও-গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজেও মনের মতো কাউকে পেল না সে। আর পাবেই বা কেমন করে? সমাজে বাবার পরিচয় যে এখনো সবচেয়ে বড়। বাবার পরিচয় না পেলে কেউ এগিয়ে আসে না। সামাজিক এই রীতি যে পায়ে এভাবে শেকল পড়াবে জয়তুন বিবি একথা ভাবলেও ছেলে এতটা ভাবেনি। তবে জয়তুন বিবির ভাগ্য ভালো একথা মানতেই হবে। ছেলে এবং মা মুখোমুখি হওয়ার আগেই জয়তুন বিবি ছেলের বিয়ে দিতে সক্ষম হলো। এ যাত্রা হাফ ছেড়ে বাঁচল সে।ছেলের বিয়ের পর জয়তুন বিবি মুখোমুখি হলো আরেক বাস্তবতার। ছেলের আচরণের সুক্ষ পরিবর্তন তার চোখ এড়ালো না। ভেতরে ভেতরে জয়তুন বিবির রক্তক্ষরণ কাউকেই বুঝতে দিল না। আসলে মানুষের ভেতরের জটিল বিষয়গুলো সে কখনও ধরতে পারত না। তার পরিচিত বা আপনজন বলতে এই সংসারে থেকেও যেন কেউ নেই। জাগতিক বিষয়গুলোর সঙ্গেও তার কোনো সখ্য নেই। সংসারের সব কিছুতেই এই যে উপেক্ষা তা জমাট বেঁধে পাথরের মতো তার বুকে চেপে রইল। জয়তুন বিবি একবার ভাবে সে তো স্বামীর সংসার ছেড়েই এসেছিল, এই সংসার আরেকবার ছেড়ে যেতে খুব কি কষ্ট হবে? উত্তর মেলে না। তার দীর্ঘশ্বাসটাই শুধু দীর্ঘ হয়। মায়ার বাঁধনে সে আটকে পড়ে। ছেলেটার মুখ পূণির্মার চাঁদের মতো ভেসে ওঠে চোখের দুই মণিতে। জয়তুন বিবি মনে মনে নিজের সঙ্গেই কথা বলে।‘আমার ছেলের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে এড়িয়ে চলে কেন?’‘আজকাল সময়টাই এমন।’মন থেকেই উত্তর আসে। কিন্তু জয়তুন বিবি কথাটা মানতে পারে না। সময়ের ওপর সব দোষ চাপিয়ে মানুষ পার পাবে কেন? তার নিজের কী বিবেক-বুদ্ধি নাই? জয়তুন বিবি পুনরায় প্রশ্ন করে।‘স্বার্থ হাসিল হইলেই মানুষ পর হইব এ কেমন কথা!’‘তুমি হলেও তাই করতে।’‘আমি ওদের মতো অত স্বার্থপর না।’ জয়তুন বিবি প্রতিবাদ করে ওঠে। ‘ছেলের সংসার আলাদা করে দিলেই তো ঝামেলা চুকে যায়।’‘এ সংসার আমার।’‘পৃথিবীতে কোনো কিছুই কারো নিজের নয়।’এই কথাটি জয়তুন বিবির খুব ভালো লাগে। মনে মনে সে বারকয়েক কথাটি আওরায়। তারপর হঠাৎ করেই বিষণ্ন হয়ে পড়ে সে। কিছুদিন পরেই সে দাদী হবে। এ সময় ওর দাদাও তো পাশে থাকতে পারত। তার জীবনে এত ‘নেই’ কেন? একটু শান্তি কি সে বিধাতার কাছে চাইতে পারে না?আর দশজনের মতো তার সংসারটাও তো স্বামী, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনীদের নিয়ে মুখর হতে পারত। ফুটফুটে নাতি-নাতনীরা পাশে পাশে সারাদিন ঘুরঘুর করত। সে স্বামীকে শুনিয়ে বলত, ‘আমার এই নাতিটা হইছে ঠিক তোমার মতো।’স্বামী কপট রাগ দেখিয়ে বলত, ‘হইবোই তো। দেখা লাগব তো এইডা কার নাতি। কিন্তু নাতনীটা হইছে ঠিক তোমার মতো ঢঙ্গী।’পান মুখের ভেতর সবটুকু পুরে দিয়ে জয়তুন বিবি বলে উঠত, ‘আমি ঢঙ্গী?’
এর পরের কথাটা জয়তুন বিবি আর ভাবার অবকাশ পায় না। তার আগেই সে পিঠে খোঁচা অনুভব করে। মিলের ম্যানেজার কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি সে। ‘ঢঙ্গীর মতো বইসা থাকলে প্যাটে ভাত যাইব না। কাম কর।’ম্যানেজারের কথায় সম্বিত ফেরে তার। পুনরায় কাজে মনোযোগী হওয়ার আগে আঁচল দিয়ে চোখটা ভালো করে মুছে নেয় সে।রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ অগাস্ট ২০১৪/তাপস রায়