মানিকগঞ্জের ঘিওরের বালিয়াখোড়ায় অবস্থিত ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পেয়েছে পরিচিতি। কিন্তু এ রিসোর্টের আড়ালের অনিয়মের গল্প একেবারেই ভিন্ন। নানা প্রভাব খাটিয়ে জমি দখল, সরকারি বিধি-নিষেধ অমান্য, অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ, অগ্নি নিরাপত্তায় অবহেলা, পরিবেশ ধ্বংস ও সামাজিক ক্ষোভ- সবকিছু মিলিয়ে রিসোর্টটি যেন অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
প্রথমদিকে বিভিন্ন কৌশলে জমি কিনলেও পরে জমির দাম পরিশোধ না করে এবং প্রভাব খাটিয়ে আশপাশের জমি দখল করে নেয় রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ। সরকারি বিধি-বিধান না মেনে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনারও অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ।
তবে কি সত্যিই ডেরা রিসোর্ট আইন মেনে চলছে? দেশের প্রচলিত বিধি-বিধান অনুযায়ী নির্মাণ ও পরিচালনা হচ্ছে কি না- এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে রাইজিংবিডি।
অনুসন্ধানে ঘিওর উপজেলা প্রশাসন, মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসন, পর্যটন করপোরেশন এবং বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র ঘেঁটে ও সরেজমিনে ঘুরে পাওয়া গেছে একের পর এক অনিয়মের চিত্র।
ডেরার ভেতরে কবরস্থান, এখন হরিণ খামার ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ কবরস্থানের চারপাশের জমি কিনে সেখানে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। পরবর্তীতে কবরস্থানের জমি ব্যবহার করে ঘর নির্মাণ করে হরিণ পালন শুরু করে তারা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পুরান গ্রামের মৃত শোভাতনের চার ছেলে মিলে মোট ১৩ শতক জমি কিনেছিলেন। পরবর্তীতে তাদের মা জমিটি ওয়াকফ করার নির্দেশ দেন। সেই অনুযায়ী তারা ১০ শতক এবং মৃত আশেক আলীর ২ শতক জমি ওয়াকফ করেন। মোট ১২ শতক জমিতে গড়ে ওঠে কবরস্থান, যেখানে এখন পর্যন্ত ১০০ থেকে ১৫০ জন মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা হয়েছে। এ কবরস্থানে প্রথম দাফন হয় মৃত শোভাতনের।
মৃত শোভাতনের ছেলে হযরত আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার মায়ের নির্দেশেই আমরা চার ভাই মিলে জমি কিনে কবরস্থান হিসেবে ওয়াকফ করেছিলাম। মৃত আশেক আলীও দুই শতক জমি দিয়েছিলেন। মোট ১২ শতক জায়গায় গড়ে ওঠে এই কবরস্থান। যেখানে আমার মাকে সবার আগে দাফন করা হয়। এখন পর্যন্ত এখানে ১০০ থেকে ১৫০ জন মানুষ সমাহিত আছেন।”
তিনি আরো বলেন, “ডেরা কর্তৃপক্ষ আশপাশের জমি কিনে নিয়ে কবরস্থানের রাস্তাই বন্ধ করে দিয়েছে। পরে তারা নতুন জায়গায় কবরস্থান করার প্রস্তাব দেয় এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৬ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও ৫ লাখ টাকা দিয়েছে। তখন তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ডেরার ভেতরে কবরস্থানটি সংরক্ষণ করবে, ফুলের বাগান বানাবে এবং যাদের আত্নীয় স্বজনের কবর আছে ওই সকল পরিবারের সদস্যরা এসে কবর জিয়ারত করতে পারবে।
‘কিন্তু বাস্তবে তারা কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। কাঁটাতারের বেড়ার আড়াল থেকে কবরস্থানটা এখন শুধু দেখা যায়। এর চেয়েও কষ্টের বিষয় হলো, কবরস্থানের ওপর ঘর বানিয়ে সেখানে হরিণ পালন করছে। এটা আমাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনের প্রতি চরম অসম্মান এবং আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত।”
অনুসন্ধান বলছে, কবরস্থানের যে জমিতে হরিণ পালন করা হচ্ছে সেখানে বন বিভাগ থেকে ছয়টি হরিণ পালনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে রিসোর্টটিতে বর্তমানে ১৯টি হরিণ পালন করা হচ্ছে। অনুমতির বাইরে বণ্যপ্রাণি পালনের বিষয়টি সরাসরি আইন ভঙ্গের শামিল। আইন অনুযায়ী ১০টির নিচে হরিণ পালন ব্যক্তিগত পর্যায়ের হলেও ১০টির বেশিকে বাণিজ্যিক বা খামারি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। ডেরা রিসোর্ট বাণিজ্যিক হিসেবে আবেদন করলেও এখনো কোনো ছাড়পত্র পাননি।
তবে রিসোর্সটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ শাদী দাবি করেন, তারা বাণিজ্যিক লাইসেন্স পেয়েছেন। তার এ দাবির সত্যতা যাচাইয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পরিদর্শক নিগার সুলতানার সাথে কথা বলেন এ প্রতিবেদক।
নিগার সুলতানা জানান, ডেরা রিসোর্ট বাণিজ্যিক লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন। আবেদনের পর নিয়ম অনুযায়ী পরিদর্শন করা হয়েছে। তবে বাণিজ্যিক লাইসেন্স এখনো প্রদান করা হয়নি।
হরিণ পালনের স্থানে কবরস্থান ছিলো এমন বিষয় জানালে তিনি বলেন, “কেউ আমাদের এমন তথ্য প্রদান করেননি। তাহলে আমরা অবশ্যই অন্যত্র হরিণের খামার করার তাগিদ দিতাম।”
ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছাড়াই চলছে ডেরা রিসোর্ট ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা অগ্নি নিরাপত্তার দিক থেকে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের শর্ত পূরণ না করায় প্রতিষ্ঠানটির ফায়ার লাইসেন্স গত দুই অর্থবছর ধরে নবায়ন হয়নি।
মানিকগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় জানায়, ডেরা রিসোর্টের অনুকূলে ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর ফায়ার লাইসেন্স (নং: ডিডি/ঢাকা/৩২৮৯৯/২০২২) ইস্যু করা হয়েছিল। লাইসেন্সটির মেয়াদ ছিল ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। ওই লাইসেন্সের সর্বোচ্চ ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) বর্গফুটের অনুমোদন দেওয়া হলেও বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটির ফ্লোর আয়তন এর চেয়ে অনেক বেশি, যা লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
অগ্নি প্রতিরোধ, নির্বাপণ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানটির জন্য একটি ফায়ার সেফটি প্ল্যান প্রণয়ন এবং তা মহাপরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদন নেওয়া জরুরি ছিল। এরপর সে মোতাবেক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ডেরা কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত সেই প্ল্যান প্রণয়ন করেনি।
ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় থেকে একাধিকবার লিখিত পত্র দিয়ে ডেরা কর্তৃপক্ষকে ফায়ার সেফটি প্ল্যান প্রণয়ন ও অনুমোদনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলেও তা মানেনি রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বিধি লঙ্ঘন করেছে। ডেরা রিসোর্টের ফায়ার লাইসেন্স ২০২৪-২০২৫ এবং ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে নবায়ন করা হয়নি।
এ অবস্থায় ডেরা রিসোর্টের হাজারো দর্শনার্থী এবং আশপাশের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এত বড় একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনা ভয়াবহ দুর্ঘটনার ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে।
এ বিষয়ে রিসোর্টটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ সাদী বলেন, “ফায়ার লাইসেন্সের জন্য সময় বর্ধিত করা হয়েছে।” তার এমন মন্তব্যের পর মানিকগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ ও আরিচা ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টর নাদির হোসেনের সাথে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তারা উভয়েই নিশ্চিত করেছেন যে, ডেরা রিসোর্টটির ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন করা নেই। যেহেতু লাইসেন্স নাই তাহলে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি এমন প্রশ্ন করলে মানিকগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ বলেন, “দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
পরিবেশের ছাড়পত্র নেই ডেরা রিসোর্টকে ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ২০টি শর্ত আরোপ করে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করা হয়। সর্বশেষ এই ছাড়পত্র নবায়ন করা হয় ২০২৪ সালের ২৫ জুন, যার মেয়াদ ছিল ২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
কিন্তু ছাড়পত্রের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও প্রতিষ্ঠানটি তা নবায়নের জন্য কোনো আবেদন করেনি। এ অবস্থায় পরিবেশ অধিদপ্তর, মানিকগঞ্জ- কর্তৃক ২০২৫ সালের ২৯ জানুয়ারি ডেরা রিসোর্ট সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। ওই পরিদর্শনে দেখা যায়- প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ছাড়পত্রের মেয়াদ এরইমধ্যে উত্তীর্ণ হলেও তা নবায়ন করা হয়নি। তাছাড়া, পরিবেশগত ছাড়পত্রের ৩ নম্বর শর্ত অনুযায়ী বর্জ্য শোধনাগার (এসটিপি) নির্মাণ করা হয়নি। অনুমোদিত লে-আউটের তুলনায় অতিরিক্ত কক্ষও তৈরি করা হয়েছে।
এ ঘটনায় মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর ডেরা কর্তৃপক্ষকে ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি লিখিত নোটিশ প্রদান করে। কিন্তু ডেরা কর্তৃপক্ষের দাখিল করা জবাব সন্তোষজনক বিবেচিত হয়নি। কারণ, পরিবেশগত ছাড়পত্র নবায়ন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছিল এবং অনুমোদিত শর্ত ভঙ্গ করা হচ্ছিল। এ কারণে ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই পরিবেশ অধিদপ্তর সদর দপ্তরের এনফোর্সমেন্ট শাখায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নথি প্রেরণ করা হয়।
পরে ২০২৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এনফোর্সমেন্ট শাখায় শুনানির দিন ধার্য করা হলেও ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ সেখানে উপস্থিত হয়নি।
এ বিষয়ে ডেরা রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ শাদী বলেন, “৮ তারিখের শুনানির ফলাফল আমরা পেয়ে গেছি। আমাদের সব ঠিক আছে। ডেরা হচ্ছে এশিউর গ্রুপ। এ গ্রুপের সব কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে।” তবে প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়ন নেই কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “কাগজপত্র সব ঠিক আছে।”
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “৮ তারিখের শুনানিতে ডেরা কর্তৃপক্ষ এনফোর্সমেন্ট শাখায় উপস্থিত হননি। ফলে শুনানির ফলাফল পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। রিসোর্টটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে।”
কৃষি জমিতে ডেরা রিসোর্ট ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়ায় উর্বর কৃষিজমি ভরাট করে বিলাসবহুল ডেরা রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এক সময় এই জমিতে সোনালি ধান ফলতো, মৌসুমভেদে ফলন হতো নানা ফসলের। এখন সেই জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে কংক্রিটের দেওয়াল, সুইমিং পুল ও হরিণের খামার।
স্থানীয় কৃষক লিটন মোল্লা বলেন, “আমাদের উর্বর জমিতে প্রচুর ধান হতো। আজ সেই জমিতে কংক্রিটের দেওয়াল আর সুইমিং পুল। কৃষির জন্য উপযোগী জমি সবই হারিয়ে গেছে। আমাদের জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
অপর স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুল দেওয়ান বলেন, “সরকারের কৃষিজমি সংরক্ষণ আইন থাকা সত্ত্বেও প্রভাব খাটিয়ে উর্বর জমি ভরাট করে রিসোর্ট বানানো হয়েছে। এক সময় যেখানে আমরা কৃষিকাজ করতাম, সেখানে এখন বিলাসবহুল স্থাপনা এবং হরিণের খামার।”
মানিকগঞ্জ কৃষি জমি সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম বলেন, “উর্বর কৃষিজমি ভরাট করে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ বাংলাদেশের কৃষিজমি সংরক্ষণ আইন ও ভূমি ব্যবহার বিধি লঙ্ঘন। এভাবে অবৈধভাবে কৃষিজমি ব্যবহার করা হলে শুধু স্থানীয় কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। কৃষিজমির ওপর নির্মিত বিলাসবহুল স্থাপনা, কংক্রিটের দেয়াল ও সুইমিং পুল স্থানীয়দের জীবন ও কৃষি সংস্কৃতিকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করছে।”
জমি ক্রয়ে নেই অনুমতি, নেই বার লাইসেন্স ডেরার রিসোর্টের দাবি, দুই হাজার চারশো শতাংশ জায়গা ক্রয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তি নামে এগারোশো শতাংশ, প্রতিষ্ঠানের নামে তেরোশো শতাংশ জমি রয়েছে। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ শাদীর নামে এক হাজার দুইশো উনচল্লিশ দশমিক নিরানব্বই শতক, জেসমিন আরা ৭০ শতক ও তমিজ উদ্দিন গং ৯২.০৫ শতকের ভূমি উন্নয়ন কর দাখিল করেছেন।
তাদের দাবি অনুযায়ী বাকি জমির ভূমি উন্নয়ন করের নথিপত্র পাওয়া যায়নি। রিসোর্টটি প্রতিষ্ঠানের নামে জায়গা কিনতে কালেক্টরেটের অনুমোদন নেয়নি। রিসোর্টটি প্রতিষ্ঠার শুরুতেই জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেনি। ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়ালের ১৬১ ও ৩২৬ নং অনুচ্ছেদ এবং ভূমি সংস্কার আইন, ২০২৩-এর ধারা ৪ অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান কৃষি জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শর্তপূরণে বাধ্য। কিন্তু ডেরা রিসোর্টের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া মানা হয়নি।
এদিকে, রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ বার লাইসেন্সের আবেদন করলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিমত, এখানে বার লাইসেন্স দেওয়া হলে এলাকায় সামাজিক অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা বাড়তে পারে।
অন্যদিকে, স্থানীয়দের অভিযোগ আরও ভয়াবহ। তাদের দাবি, রিসোর্টে উচ্চ শব্দে গান-বাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। এ কারণে এলাকার ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আলেম-উলামা, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ লিখিতভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
একাধিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকার পরও রিসোর্টটির বিরুদ্ধে এখনো কোনো কার্যকর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্থানীয়দের মতে, রিসোর্টের মালিক শেখ সাদী রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। আগে তিনি ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির পদধারী। ফলে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিতে সাহস পাচ্ছে না।
ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, রিসোর্ট আইন মেনেই পরিচালিত হচ্ছে। অথচ সরকারি বিভিন্ন নথি ও সরেজমিন অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা।
অনুসন্ধান শেষে গত বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকালে এশিউর গ্রুপের ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ সাদীর কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগে অনুমোদন ছাড়াই তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হচ্ছে।
শেখ সাদী দাবি করেন, তার সকল অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ওই অনুমোদনের কপি সেদিন বিকাল ৪টায় তিনি এ প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপে সরবরাহ করবেন বলে জানান। বিভিন্ন দপ্তরের অনুমোদন নবায়ন ছাড়াই তার প্রতিষ্ঠান চলছে এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনই নিশ্চিত করেছেন বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, “সব ঠিক আছে, আমাদের অনুমোদন নবায়ন আছে।”
তবে সেদিন বিকেল সোয়া ৪টায় এ প্রতিবেদক তার মুঠোফোনে কল করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও আর কোন নথিপত্র বা অনুমোদনের কপি সরবরাহ করেননি।
এর আগে ডেরা রিসোর্ট সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন লিখে রিসোর্টের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুকের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তবে, ‘সব অনুমোদন আছে, আপনাকে সরবরাহ করা হবে’ বলে একাধিকবার সময় নিয়েও তা দেখাতে পারেননি তিনি।
ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “রিসোর্ট ব্যবসায়ীদের অবশ্যই আইন-কানুন মেনে চলতে হবে। রিসোর্ট পরিচালনায় ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, জমি ক্রয়ে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমোদন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়সহ একাধিক দপ্তরের প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও নবায়ন বাধ্যতামূলক। পর্যটনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা যেমন দিতে হবে, তেমনি আইনের ব্যত্যয় ঘটলে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “রাজনৈতিক প্রভাববলয়ের আশ্রয়ে প্রতিষ্ঠানটি একাধিক অনিয়মে জড়িয়েছে। সরকারি বিধি-বিধান অমান্য করে ক্ষমতার দাপট দেখানো হয়েছে। চোখের সামনে এমন দুর্নীতি হলেও প্রশাসনের কেউ আইন প্রয়োগ করেনি। অসাধু আমলাদের যোগসাজশ থাকায় এসব সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির বিচার হয়নি। অসাধু কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির রোষাণলে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যেন এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হয়।”
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড.মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “সরকারি বিধি বিধান অনুসরণ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে আমরা সহযোগিতা করব। কিন্তু আইনের ব্যতয় ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ডেরা রিসোর্টের নানাবিধ অনিয়মের বিষয়ে পর্যটন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। ঊদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে রিসোটর্টির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পরিকল্পনা-২) জেবুন নাহার ইমেইলে পাঠানো লিখিত বক্তব্য জানান, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. আনিসুর রহমান বলেন, “প্রশিক্ষণে থাকার কারণে বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”