জাতীয়

দুর্গোৎসব ঘিরে সর্বোচ্চ সতর্কতা, সরকারের কঠোর নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি

শারদীয় দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় আচারের উৎসব নয়, এটি হাজার বছরের ঐতিহ্য আর মানবিক বন্ধনের মিলনমেলা। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য বছরের সবচেয়ে বড় এই উৎসব এবার উদযাপিত হচ্ছে এক নতুন বাস্তবতায়, যেখানে ধর্মীয় আনন্দের পাশাপাশি নিরাপত্তা, সামাজিক সম্প্রীতি এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

গত  ২১ সেপ্টেম্বর  স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সভাপতিত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সূত্রে জানা গেছে, ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে দুর্গাপূজা। 

গত বছর সারাদেশে ৩১ হাজার ৪৬১টি মণ্ডপ ও মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মহানগর এলাকায় গত বছর ২৫২টি মণ্ডপ ও মন্দিরে দুর্গাপূজা হয়েছিল।

গত বছরের তুলনায় সংখ্যায় বৃদ্ধি স্পষ্টভাবে একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, উৎসব পালনে সক্রিয়তা বাড়ছে।

রাজধানী থেকে মফস্বল, সর্বত্র পূজামণ্ডপে প্রস্তুতি এখন চূড়ান্ত ধাপে। প্রতিমা নির্মাণ, মণ্ডপ সাজানো, আলোকসজ্জা এবং সাংস্কৃতিক আয়োজনে ব্যস্ত সময় পার করছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

বিভিন্ন জেলার পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দ  বলছেন, আমরা আশাবাদী, এবার উৎসব হবে নির্বিঘ্ন, আনন্দময়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও প্রস্তুতি খুব ভালোভাবে হয়েছে।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, আনসার ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে সর্বাত্মক পরিকল্পনা। গোয়েন্দা তৎপরতা, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ও স্থানীয় পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবী দলগুলোকে সম্পৃক্ত করে তৈরি করা হয়েছে একটি শক্তিশালী নিরাপত্তা বলয়।

প্রস্তুতির চিত্র 

* ২ লাখ আনসার সদস্য পূজামণ্ডপ ও আশপাশের এলাকায় মোতায়েন থাকবে।

* ‘শারদীয় সুরক্ষা অ্যাপ’ চালু হয়েছে। যার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের ঘটনার তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানানো যাবে।

* ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী নারী-পুরুষ দায়িত্ব পালন করবেন আনসার বাহিনীর সঙ্গে।

* প্রতিটি থানায় গঠিত হয়েছে বিশেষ মনিটরিং টিম, যারা স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিটি মণ্ডপে নজরদারি বজায় রাখবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বৈঠকে বলেন, কেউ যেন সুযোগ নিয়ে উস্কানি দিতে না পারে সেজন্য এবারের নিরাপত্তা প্রস্তুতি আরো ব্যাপকভাবে নেওয়া হয়েছে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সফল করতে একযোগে কাজ করছে পাঁচটি বাহিনী

* পুলিশের থানাভিত্তিক টহল থাকবে, স্ট্রাইকিং ফোর্স, মনিটরিং সেল কাজ করবে।

* র‍্যাবের মোবাইল টিম, বোম ডিসপোজাল, সাইবার নজরদারি করবে।

* আনসার‑ভিডিপির সদস্য মণ্ডপের নিরাপত্তা, অ্যাপস ব্যবহার, স্বেচ্ছাসেবী সমন্বয়ে কাজ করবে। বিজিবির সীমান্তবর্তী এলাকায় বিশেষ নজরদারি থাকবে।

* সেনাবাহিনীর উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়  সহায়তা দিতে  প্রস্তুত থাকবে। সর্বত্র এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যাতে যে কোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো সম্ভব হয়।

সোশ্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণে সাইবার ইউনিট

উৎসবকালে বিভ্রান্তিকর গুজব বা উস্কানিমূলক পোস্ট যেন কোনোভাবেই সমাজে বিভেদ সৃষ্টি না করে, সেজন্য চালু রাখা হয়েছে সাইবার মনিটরিং সেল। এছাড়া তাৎক্ষণিক অ্যাকশন টিম গঠন করা হয়েছে। র‍্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা ইউনিট যৌথভাবে কাজ করবে। কনটেন্ট ট্র্যাকিং টুল ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

বৈঠকে ঢাকা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান জানিয়েছেন, যেকোনো গুজব বা উসকানি চিহ্নিত করা হবে দ্রুত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তাৎক্ষণিক নেওয়া হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছর দেশে পূজা হয়েছে ৩১ হাজার ৪৬১টি মণ্ডপে, আর এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি। ঢাকায় মণ্ডপের সংখ্যা ২৫২ থেকে বেড়ে ২৫৮। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার নয়, বরং সম্প্রদায়ের আত্মবিশ্বাস, রাষ্ট্রের সহানুভূতি এবং সামাজিক সমর্থনের একটি প্রতিচ্ছবি।

তিনি বলেন, পূজায় আমরা শুধু নিরাপত্তা নয়, সম্প্রীতির উদাহরণ তৈরি করতে চাই। সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও সহযোগিতার বার্তা ছড়াতে চাই। উচ্চ ও মাঝারি ঝুঁকির এলাকাগুলোতে বাড়তি প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

রাজধানীর রায়েরবাগের বাসিন্দা  হরলাল ঘোষ বলেন, ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। ধর্ম হলো স্বাধীন অনুশীলনের বিষয়, কোনো আতঙ্কের মধ্যে নয়। আমরা চাই এক নিরাপদ, সহনশীল, মানবিক বাংলাদেশ। জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাই বাস্তবায়ন করতে হবে রাষ্ট্রকে, সমাজকে। আমরা চাই এই উৎসব শুধু চোখে না, মানুষের মনে আনন্দ ছড়াক।

তিনি বলেন, শারদীয় দুর্গোৎসব শুধু পূজার সময়সূচি নয়। এটি একটি চেতনার উৎসব, যেখানে প্রত্যাশা থাকে সহাবস্থানের, সৌহার্দ্যের এবং পারস্পরিক সম্মানের।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জয়দেব দাস বলেন, বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো বহু ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির এক অপূর্ব মিশ্রণ। এই বহুত্ববাদকে রক্ষা করা এবং ধর্মীয় উৎসবগুলোতে সবাইকে নিরাপত্তা ও মর্যাদা দেওয়া রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের দায়িত্ব।

তিনি বলেন, এ বছর পূজাকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি, সামাজিক উদ্যোগ, প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা এবং জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। যেখানে সংকট নয়, শান্তি-সম্প্রীতিই হবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আমরা যেন এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি যেখানে প্রতিটি উৎসব ভয় নয়, বিশ্বাসে উদযাপিত হবে, যেখানে সংখ্যালঘু নয়, সহনাগরিক হিসেবে সবাই নিজের জায়গায় নিরাপদ থাকবে, আর পূজামণ্ডপগুলো হয়ে উঠবে শুধু প্রতিমা দর্শনের স্থান নয়, সম্প্রীতির আলোকস্তম্ভ, এটাই চাওয়া।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও দুর্গাপূজা ২০২৫ উপলক্ষে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। পূজার নিরাপত্তার জন্য ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করবে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরো বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন-গ্রাউন্ড ডিপ্লয়মেন্ট গত ২৪ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে। বর্তমানে থানা পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি এবং আনসার টহল দিচ্ছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ৮০ হাজার ভলান্টিয়ার মোতায়েন থাকবে, যাতে পূজা খুব ভালোভাবে উদযাপিত হয়। পূজা কমিটি তাদের মণ্ডপে সাতজন করে গার্ড রাখবে। কোনো জেলাকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে না।

উপদেষ্টা  বলেন, এটি একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান হওয়ায় এর পবিত্রতা রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। মণ্ডপে জুতা বা স্যান্ডেল নিয়ে ওঠা যাবে না। এই বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে, যেন কোনোভাবেই এর পবিত্রতা ভঙ্গ না হয়।