ঢাক-ঢোল আর সুরের মূর্ছনা ছাড়া পূর্ণতা পায় না দুর্গাপূজা। পূজার প্রতিটি পর্বে তাই থাকে ঢাকের সুরের আবহ। এই প্রয়োজন থেকেই প্রতি বছরের মতো এবারো কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে বসেছে প্রায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট।
এবারের হাটে বিক্রমপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীসহ দেশের নানা জেলা থেকে দুই শতাধিক বাদকদল হাজির হয়েছেন নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলবে রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ষষ্ঠীর গভীর রাত পর্যন্ত।
নাম ‘ঢাকের হাট’ হলেও এখানে কোনো বাদ্যযন্ত্র কেনাবেচা হয় না। এখানে আসেন যারা, সবাই বাদ্যযন্ত্র বাজান। তাদের বাজনা শুনে, দক্ষতা যাচাই করে পূজা আয়োজকেরা মণ্ডপে বাজানোর জন্য তাদের ভাড়া করে নেন। সম্মানি নির্ধারিত হয় দল বা সদস্যসংখ্যা, বাদ্যযন্ত্র আর দক্ষতার ওপর। এই ঢাকের হাট শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নয়, ভিড় করছেন অন্য ধর্মের লোকজনও। তাদের কাছে এই হাট শুধুই বাদ্যযন্ত্রের নয়, এটা এখন ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির অংশ।
আজ দুপুরে হাটে গিয়ে দেখা যায়, বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে কটিয়াদী সদরের পুরান বাজার এলাকা। ঢাক, ঢোল, কাঁসি, সানাই, করতাল আর বাঁশির শব্দে জমে উঠেছে হাটের পরিবেশ। সুরের তালে তালে চলছে প্রতিযোগিতা-কে বাজাবেন সেরাটা। কার সুরে মুদ্ধ হবেন পূজার আয়োজকরা। বাদকরা নিজেদের সুর আর দক্ষতা উজাড় করে দিচ্ছেন মণ্ডপে বাজানোর সুযোগ পেতে। আয়োজকেরা ঘুরে ঘুরে শুনছেন, পছন্দ করছেন, চলছে দরদামও। যার বাজনায় মন গলছে, তার সঙ্গেই হচ্ছে চুক্তি।
ঘোড়াশালের পূজা আয়োজক কাজল চন্দ্র ভৌমিক বলেন, “ঐতিহ্যবাহী এ হাটের কথা শুনে এবারই প্রথম এলাম। একজন ঢাকীকে মনে ধরেছে। তিনি ঢাক বাজান ভালো। ১৮ হাজার টাকায় তার সঙ্গে রফা হয়েছে।”
ঢাক-কাঁসির আওয়াজে মুখরিত হচ্ছে কাদিয়াদির বাদ্যযন্ত্রের হাট
কিশোরগঞ্জ সদরের অনুকূল দেবনাথ জানান, “তাদের মণ্ডপের জন্য পাঁচজনের বাদক দল নিয়েছেন ৯০ হাজার টাকা দিয়ে। তিনি বলেন, “এবার বাদকদল কিছুটা কম এসেছে। চাহিদা বেশি থাকায় টাকা একটু বেশি লাগছে।”
বিক্রমপুরের ঢাকি পরিমল দাস বলেন, “ফোনে অনেকে যোগাযোগ করেছিল, যাইনি। এখানে না আসলে মন মানে না। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। এর আনন্দটাই আলাদা। আমি ২০ হাজার টাকা চেয়েছি। দর কশাকশি চলছে, কমবেশি করে চলে যাব।”
বাদকদলের সদস্য সুমন মণিঋষি জানান, তিনি তার দল নিয়ে গত ২০ বছর ধরে এই হাটে আসছেন। তিনি এবার দেড় লাখ টাকা চেয়েছেন। এক লাখ ২০ হাজার টাকা পেলে বাজাতে যাবেন।
স্থানীয়রা জানান, হাট এখন আর শুধু হিন্দুদের নেই। সব ধর্মের লোকজন আসেন। ঢাকঢোল ও সুরের মূর্ছনা শুনতে এখানে চলে আসেন তারা। হাটটি উৎসবের স্থানে পরিণত হয়। সব মিলিয়ে এটি স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
ঢাকের হাটের সমম্বয়ক শীতল চন্দ্র সাহা বলেন, “স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শ্রী মা সংঘ হাটের তত্ত্বাবধান করছে। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের সময় শুরু হয় কটিয়াদীর এই ঢাকের হাট। রাজপ্রাসাদে পূজার জন্য সেরা ঢাকির সন্ধানে বার্তা পাঠানো হয়েছিল বিক্রমপুরে। সেখান থেকে বহু ঢাকি নৌপথে কটিয়াদীতে আসেন। রাজা নিজে তাদের বাজনা শুনে সেরা দল বেছে নেন। সেই থেকেই শুরু হয় এই ঐতিহ্যের যাত্রা। হাটে আসা বাদকদের থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করছে ওই সংগঠন।”