মতামত

প্রবীণদের কল্যাণে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ: আশা ও হতাশা

বাংলাদেশের সমাজে একটি দীর্ঘমেয়াদি অথচ পরিচিত সমস্যা হলো- প্রবীণ সমস্যা। প্রবীণ বা বার্ধক্য একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সামাজিক সমস্যা, যা ব্যক্তিজীবন, পরিবার, গ্রাম, শহর, উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সব অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো ও তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যিকার অর্থে একটি জাতির উন্নয়নের প্রকৃত মাপকাঠি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নয়, বরং তা নির্ধারিত হয় সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রতি তার দায়িত্ববোধ থেকে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের তথ্য (২০২৪) অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ৬৫ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০.৩ শতাংশ, যেখানে ১৯৭৪ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৫.৫ শতাংশ। জনসংখ্যা ও গৃহ গণনার (২০২২) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ।

বয়োবৃদ্ধির সক্রিয়তা তত্ত্ব অনুযায়ী, কর্মে নিযুক্ত থাকলে প্রবীণগণ ভালো থাকেন। তবে আমাদের দেশে একদিকে সনদধারী বেকার, অন্যদিকে প্রশিক্ষণবিহীন লোকবল ও কাজ-কর্মে ফাঁকি দেওয়া বা অনীহার সংস্কৃতির কারণে ভালো থাকা হয়ে ওঠে না।

বয়োবৃদ্ধির বিযুক্ত তত্ত্ব অনুযায়ী, কর্ম থেকে দূরে থাকা যেমন প্রবীণদের জন্য ভালো, তেমনি সমাজের জন্যও ভালো। কিন্তু এ কথা সত্য যে, প্রাত্যহিক জীবনে কর্ম থেকে দূরে থাকা বাংলাদেশের প্রবীণদের জন্য প্রায় অসম্ভব। মাত্র চার দশক আগেও একান্নবর্তী পরিবারের ছায়ায় প্রবীণরা ছিলেন সম্মানিত ও নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে একক পরিবার ব্যবস্থায় প্রবীণরা হয়ে উঠেছেন পরিবারের বোঝাস্বরূপ। সন্তানরা তাদের ভরণপোষণে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে আর সমাজের ভেতরে প্রবীণদের মর্যাদা প্রায় বিলুপ্তির পথে।

চারদিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন, ব্যাংকে হয়রানি, গণপরিবহণে অপমান, রাস্তা-ঘাটেও নানা বঞ্চনা ইত্যাদি। বিশেষ করে শারীরিকভাবে দুর্বল ও আয়বিহীন এই জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত চিকিৎসা, বাসস্থান, সামাজিক সম্মান ও ন্যূনতম মানবিক সেবার অভাবে ভুগছেন। পত্রিকার পাতায় এখনো পড়তে হয় শিক্ষিত সন্তান মাকে রাখছেন বৃদ্ধাশ্রমে অথবা নিজের সন্তান মাকে ফেলে এসেছেন দূরের কোন জঙ্গলে।

অন্যদিকে, সরকারি নিবাসে মাত্র ৩০০ জন প্রবীণের জায়গা বরাদ্দ রয়েছে। অথচ দেশে ৬৫ ঊর্ধ্ব প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১.৩ কোটি, যা তাদের প্রতি রীতিমতো রাষ্ট্রীয় প্রহসন ব্যতিত আর কিছুই নয়! 

১৯৭২সালের সংবিধানে প্রবীণদের নিয়ে আলাদা কোনো ধারা রাখা হয়নি। তবে ধারা ১৫, ১৯ ও ২০ পরোক্ষভাবে প্রবীণদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নীতিমালায় সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্কের আওতায় কিছু সীমিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি চালু হলেও এর পরিধি ও বিস্তৃতি ছিল খুব কম। যদিও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এটি ৬৫০ করা হয়েছে সেটিও প্রবীণদের চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

সরকার কর্তৃক জাতীয় পেনশন স্কিম থাকলেও বৃহৎ অংশের প্রবীণ যারা চাকরিতে ছিলেন না, তারা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্কের আওতায় থাকা সত্ত্বেও সবাই এই সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন কিছুটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও এর কার্যকারিতা বেশ সীমিত।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে প্রবীণ ফাউন্ডেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে এটি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৩ সালে জাতীয় প্রবীণ নীতিমালায় প্রবীণদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা, দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা, প্রতিষ্ঠানিক সেবা ও আবাসন সুবিধা, পরিবহন ও অন্যান্য সুবিধা, আইনি সহায়তা ও পরিচয়পত্র প্রদানের মতো বিষয় উল্লেখ থাকলেও তা চোখে পড়ার মতো বাস্তবায়ন এখনো দেখা যায়নি। এসব ক্ষেত্রে হতাশার কারণ অনেক।

প্রথমত, সরকারের উদ্যোগগুলো অপ্রতুল, সমস্যাগ্রস্ত ও টপ-ডাউন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত; দ্বিতীয়ত, এসব কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তার যথাযথ মনিটরিং ও মূল্যায়ন নেই; তৃতীয়ত, প্রশাসনিক জটিলতা ও ক্ষমতাসীন দলের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে; চতুর্থত, প্রবীণরা নিজের সমস্যাগুলো প্রকাশ্যে বলতে দ্বিধাবোধ করেন; পঞ্চমত, প্রবীণবিষয়ক গবেষণার পরিমাণও অত্যন্ত কম।

এছাড়াও নানা ধরনের সমস্যার কারণে সরকারের উদ্যোগগুলো অনেক প্রবীণের দোরগোড়ায় সঠিকভাবে পৌঁছায় না। আবার অনেক সময় দুর্নীতি, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের অভাবের কারণে বহু প্রবীণ বঞ্চিত হন।

টেকসই সমাজ বিনির্মাণে ও বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো এবং ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে এই জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। তাদের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে- তবেই সমাজ এগিয়ে যাবে, রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রবীণ জনগোষ্ঠী এখন সেই অবহেলিত শ্রেণি, যাদের অধিকাংশই পারিবারিক ভাঙনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে অবস্থান করে থাকেন। এদের কল্যাণে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য ও ফলপ্রসূ হয় সে প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

আশা ও হতাশার দোলাচলে দিন পার করছেন দেশের কোটি প্রবীণ নাগরিক। রাষ্ট্র প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি চালু করলেও তা সর্বজনীন নয়। অন্যদিকে ‘সিনিয়র সিটিজেন’ ঘোষণা করা হলেও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তার ন্যূনতম চিহ্ন নেই। অথচ অন্যান্য দেশের দিকে নজর দিলে আমাদের অবস্থান সহজেই অনুমান করতে পারি। 

নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্কসহ অনেক দেশে ওয়েলফেয়ার স্টেট মডেল থাকার কারণে প্রবীণদের দায়িত্ব সরকার নিজে গ্রহণ করে। জার্মানিতে বাধ্যতামূলক সামাজিক পেনশন, ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় পেনশন ও আবাসিক সুবিধা, জাপানে দীর্ঘমেয়াদি কেয়ার ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পেনশন ও জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা চালু থাকায় প্রবীণগণ বার্ধক্য নিয়ে অতটা চিন্তিত নন। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ওল্ড এজ সিকিউরিটি (ওএএস) এবং গ্যারান্টেড ইনকাম সাপ্লিমেন্ট কর্মসূচির মাধ্যমে কম আয়ের প্রবীণদের সম্পূর্ণ সরকারিভাবে সুরক্ষা দেওয়া হয়।

কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতায় আমাদের দেশের প্রবীণরা জীবন বাঁচাতে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে। অনিশ্চয়তাকে বয়ে চলে নিজেদের অসহায়ত্বে বন্দী রাখেন। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ১, ৩, ১০ ও ১৬ ধারায় প্রবীণদের অর্ন্তভূক্তি ও সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু এসডিজি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অন্তত সেই বাস্তবতায়ও প্রবীণদের জরুরিভিত্তিতে সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।  

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের প্রবীণদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগগুলো একদিকে যেমন প্রশংসার দাবিদার, অন্যদিকে এগুলোর যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে হতাশা দূর করতে সরকারকে আরো বদ্ধপরিকর হওয়া প্রয়োজন।

‘প্রবীণ ফাউন্ডেশন’ গঠন, সামাজিক সর্বজনীন পেনশন স্কিম, বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা, প্রবীণদের জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে প্রবীণদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে, তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। রাষ্ট্র জাতীয় প্রবীণ নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, প্রবীণদের জন্য সুরক্ষা, সম্মান ও কার্যকর সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। একইসঙ্গে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধে ‘সবার আগে প্রবীণ’ এই মানবিক বোধ জাগ্রত করতে হবে।

এছাড়া, সরকারের কাজে সহায়তা করার জন্য প্রবীণ, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, সমাজের সবার সচেতনতা, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা, মিডিয়ায় তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন, বেসরকারি সংগঠনগুলোর ইতিবাচক উদ্যোগসহ সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রবীণ কল্যাণ ত্বরান্বিত করা শুধু প্রয়োজনই নয়, অতিব জরুরি।

একটা কথা আমাদের মগজে ঢুকাতে হবে- একটি দেশ তখনই সভ্য, যখন তার প্রবীণরা নিরাপদ, সম্মানিত ও সুখী।

(লেখক: শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)