দুই দশকের পরিক্রমায় এবারের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষার ফলাফল সবচেয়ে হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরেছে। ২১ বছরের মধ্যে এটাই সর্বনিম্ন পাসের হার।
শিক্ষা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার নেমে এসেছে ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম। অর্থাৎ এ বছর প্রায় ৪৩ শতাংশ পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য। শুধু পাসের হারই নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন শিক্ষার্থী, তার আগের বছর ৭৮ হাজার ৫২১ জন। কিন্তু এবার সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৬৩ হাজার ২১৯ জনে।
শিক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতা শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরকার ‘গলদ’ বা দীর্ঘদিনের শেখার সংকটের প্রতিফলন।
দুই দশকের ফলাফলের ওঠানামা
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, ২০০৫ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৫৯ শতাংশের কিছু বেশি। পরের বছরগুলোতে তা ক্রমে বেড়ে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে ঘুরতে থাকে। ২০০৮ সালে পাসের হার প্রায় ৭৫ শতাংশে পৌঁছায়, ২০০৯ সালে সামান্য কমে ৭০ দশমিক ৪৩ শতাংশ হয়। এরপর ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গড় পাসের হার ছিল ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় সরাসরি পরীক্ষা না হওয়ায় ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ সবাইকে পাস করানো হয়। ২০২১ ও ২০২২ সালে সীমিত প্রশ্নপত্রে নেওয়া পরীক্ষায় পাসের হার একবার ৮৪ শতাংশ, আরেকবার ৯৫ শতাংশ ছাড়ায়। কিন্তু ২০২৩ সালে তা আবার কমে ৮০ শতাংশের নিচে নামে। আর এ বছর পাসের হার নেমে আসে ভয়াবহভাবে; দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশে। যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
ইংরেজি ও আইসিটিতে বেশি অকৃতকার্য
শিক্ষা বোর্ডের বিশ্লেষণ বলছে, ইংরেজি ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে তুলনামূলক বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এই দুই বিষয়ের দুর্বল পারফরম্যান্সই সামগ্রিক পাসের হারকে টেনে নামিয়েছে।
অনেক শিক্ষক মনে করছেন, অনলাইন শিক্ষার দীর্ঘ প্রভাব, মৌলিক শেখার দুর্বলতা ও পাঠ্যক্রমে হঠাৎ পরিবর্তন—সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে পারেনি।
গত বছরের তুলনায় এ বছর শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে কমেছে। ২০২৪ সালে ১ হাজার ৩৮৮টি প্রতিষ্ঠান শতভাগ পাস করেছিল। কিন্তু এবার তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৪৫টিতে।
অন্যদিকে, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০২, যা গত বছর ছিল মাত্র ৬৫টি।
গলদ আছে
ফলাফল প্রকাশের পর আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, “আমরা কোনোভাবেই নম্বর ছাড়ে ছকবাঁধা নির্দেশ দিইনি। প্রতিটি উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে নিয়ম অনুযায়ী এবং সঠিক মূল্যায়নের জন্য সময়ও বাড়ানো হয়েছিল।”
তিনি বলেন, “এই যে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস করল না, এটা তো কাঙ্ক্ষিত নয়। আমরা যেন এক আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি, যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ আছে; অবশ্যই গলদ আছে। সেই গলদের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে তা সংশোধন করতে হবে। সেই দায় শুধু বোর্ড বা শিক্ষকদের নয়, আমাদের সবার।”
সংস্কৃতি বদলানো দরকার
শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) বলেন, “এ বছর এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল অনেককেই বিস্মিত করেছে। কিন্তু এর উত্তর খুব জটিল নয়। শেখার সংকট বাংলাদেশের শিক্ষায় বহু বছর ধরে চলে আসছে। আর সেটা শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই।”
তিনি বলেন, “আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি, যেখানে পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক, জিপিএ-৫ এর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মানদণ্ড। এই সংখ্যাগুলোর পেছনে আমরা শেখার আসল উদ্দেশ্যটা ভুলে গেছি। ফলাফল ‘ভালো’ দেখাতে গিয়ে আমরা প্রকৃত শেখার সংকট আড়াল করেছি। এখন সেই মুখোশ সরে গেছে। আজ প্রয়োজন শেখার মান উন্নয়নের সংস্কৃতি গড়ে তোলা।”
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কণ্ঠে হতাশা
ফলাফল ঘোষণার পর ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা দেখা গেছে।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সামিরা সোয়া বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম পাসের হার অনেক বেশি হবে। কিন্তু বাস্তবে সবাই হতাশ। ইংরেজি পেপারটা অনেক কঠিন ছিল।”
ঢাকা কলেজের এক অভিভাবক গোলামা মোস্তফা বলেন, “আমার ছেলে ভালো রেজাল্ট করবে বলে আশা করেছিলাম, কিন্তু জিপিএ-৫ পায়নি। অনলাইন ক্লাসের পর সেই ঘাটতি পূরণ হয়নি। বোর্ডের উচিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো।”
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) আজিমপুর গভমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজেও দেখা গেছে একই দৃশ্য। অনেকে মুঠোফোনে ফলাফল দেখেই হতাশ মুখে বাড়ি ফিরেছেন। অনেকেই বলছেন, গত দুই বছরের তুলনায় প্রশ্ন ও মূল্যায়ন ছিল কঠিন ও কড়াকড়ি।
শেখার ঘাটতি ও কাঠামোগত সমস্যা
শিক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ফলাফল কেবল নম্বরের ব্যর্থতা নয়; এটি শিক্ষাব্যবস্থার একটি গভীর সংকেত।
অনেকে বলছেন, নতুন পাঠ্যক্রমে প্রয়োগের অস্পষ্টতা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ঘাটতি এবং বাস্তবমুখী মূল্যায়নের অভাব—এসব কারণেই শিক্ষার্থীরা ব্যর্থতার মুখে পড়ছে।
ঢাকা কলেজের এক শিক্ষক বলেন, “আমরা মুখস্থভিত্তিক শিক্ষার বাইরে আসতে পারিনি। ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়গুলোতে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সেই সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি।”
তিনি বলেন, “ফলাফল বিশ্লেষণে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শেখার মান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। পাসের হার কমে যাওয়া বা জিপিএ-৫ কম পাওয়া হয়ত সাময়িক ধাক্কা। কিন্তু এই ধাক্কা দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল করে দিতে পারে।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা যে আয়নায় নিজেদের দেখলাম, সেটাকে উপেক্ষা করলে বিপদ আরো গভীর হবে। এই ফলাফলই হতে পারে নতুন করে শিক্ষা পুনর্গঠনের সূচনা বিন্দু, যেখানে লক্ষ্য হবে শুধু পাশ নয়, প্রকৃত শেখা ও দক্ষতা অর্জন।”
অন্যদিকে, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার বলেন, “সংখ্যা নয়, শেখাই হোক আমাদের আসল লক্ষ্য।”
বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদদের মতে, এই বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে শিক্ষা বোর্ডে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্যদের নিয়োগ, দুর্বল নীতিমালা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দায়িত্বহীনতা।
রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. দীপকেন্দ্র নাথ দাস বলেন, “২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ভয়াবহ ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। গড় পাসের হার মাত্র ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ফেল করেছে ৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী।”
তিনি বলেন, “যোগ্য নেতৃত্ব ও কার্যকর পলিসির অভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। বর্তমানে অনেক শিক্ষক ক্লাসে মনোযোগ দেন না। শিক্ষার্থীরাও কোচিংনির্ভর হয়ে পড়ছে, যা প্রকৃত জ্ঞানের বিকাশ ঘটাচ্ছে না।” এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে ফলাফল আরো খারাপ হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।