সারা বাংলা

পূজামণ্ডপে যেন ধ্বণিত হচ্ছে গাজার শিশুদের আর্তনাদ

পূজা মানে আনন্দ আর সম্প্রীতির বন্ধন। সকলে মিলেমিশে উৎসব। এবারও আলোয় মোড়া উৎসব, তবু কোথাও যেন বিষাদের ছায়া। যে আনন্দ নিয়ে দর্শনার্থীরা পূজামণ্ডপে প্রবেশ করছেন, মুহূর্তে সেই মুখমণ্ডল স্তব্ধতায় মলিন। মণ্ডপের চারপাশের দেয়াল জুড়ে ফিলিস্তিনের গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুর কান্নার, ধ্বংসের আর করুণ চাহনির ছবি ছাপিয়ে যাচ্ছে পূজার আনন্দ। 

ছবির কোনো শিশু ক্ষুধার জ্বালায় জ্বলছে, কেউ যুদ্ধ থেকে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে, কেউ বা আবার মুক্তির পথ খুঁজছে। এমনই শিউরে উঠা মণ্ডপ সাজিয়েছে কিশোরগঞ্জের জেলা শহরের বত্রিশ এলাকায় প্রগতি সংঘ। থিম দেওয়া হয়েছে ‘দুঃখরূপং’। জেলা শহরের বত্রিশ এলাকার মণ্ডপটির ৭২তম বর্ষে তারা এ দুঃখ উন্মোচনের আয়োজন নিয়ে হাজির হয়েছে ভক্তদের সামনে।

মণ্ডপের চারপাশে টানানো দুই শতাধিক ছবিতে ফুটে উঠেছে গাজার ধ্বংসস্তূপে হারিয়ে যাওয়া শৈশব। কেউ কাঁদছে ধোঁয়ার মধ্যে, কেউ খুঁজছে হারানো মা-বাবাকে। আলোর ঝলকানির মধ্যে দেখা যায় সেই ছবিগুলোর ভয়ার্ত মুখ। কালীমূর্তির চারপাশে সাজানো হয়েছে এই সকল শিশুদের ছবি।

আলো আর অন্ধকারের খেলায় সাজানো প্যান্ডেল। তবু চারদিকে অদ্ভুত নীরবতা। উৎসবে ঠাঁই পাওয়া গাজার কঙ্কালসার শিশুদের ছবিগুলো এ পূজায় পৃথিবীর গভীর অসুখের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে বার বার।

আয়োজকদের একজন সৈকত মজুমদার বলেন, ‘‘আমরা চায়, কেবল আনন্দ নয়; আনন্দের মাঝেও মানবতার কথা ভাবুক মানুষ। আমরা বলতে চেয়েছি, আনন্দ তখনই পূর্ণ হয়, যখন তাতে থাকে মানবতার ছোঁয়া। আর যুদ্ধ নয়, একটি যন্ত্রণামুক্ত পৃথিবী, শিশুদের জন্য নিরাপদ বিশ্বের স্বপ্নই পূজায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি।’’ 

দর্শনার্থীদের চোখে বিস্ময় আর মনে বেদনা। কেউ নীরবে ফুল দিচ্ছেন শিশুদের ছবির সামনে, কেউ আবার কাঁধে বাচ্চাকে তুলে দেখাচ্ছেন মণ্ডপের আলো। তাদের চোখে–মুখে মায়াভরা আবেগ। কেউ নীরবে প্রার্থনা করছেন। কেউ আবার মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করছে শিশুগুলোর মুখ। পূজার মণ্ডপ হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের কণ্ঠ, আর মানবতার পাঠশালা।

দর্শনার্থীরা ঘুরতে এ মণ্ডপে এসে থমকে যাচ্ছেন। ছবিগুলো তাদের ভাবাচ্ছে। ভয়াল যুদ্ধের দৃশ্য ফুটে উঠছে তাদের চোখে। তাদের একজন বিশাখা ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘আমরা দূর থেকে শুধু যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার কথা শুনি। কিন্তু এই খেলা যে কতটুকু নিমর্ম, এই ছবিগুলো তার প্রমাণ। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমরা মানবতার প্রতিফলন দেখতে চাই।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘যারা এমন (পূজার) আয়োজন করেছেন, তাদের মানবতা জাগ্রত ছিল বলেই, তারা এমন ভেবেছেন। এমন আয়োজন আনন্দের মাঝেও মানবতা মনে করিয়ে দেয়।’’ 

এমন আয়োজনের কারণ হিসেবে প্রগতি সংঘের পূজা আয়োজক কমিটি সভাপতি রবীন সাহা বলেন, ‘‘এই শিশুরা শুধু গাজার নয়, এরা মানবতার প্রতীক। মা কালী যেমন অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তেমনি আয়োজকরাও দাঁড়াতে চেয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আমরা চেয়েছি মানুষকে বুঝাতে; একটি জাতি, একটি দেশ কীভাবে নৃশংসতার শিকার হয়েছে। এসব শিশুদের আর্তনাদের ছবি দেখে মানুষ যেন তাদের সম্প্রীতি ও ভালোবাসা জীবিত রাখে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।’’ 

উৎসবের মাঝেও তরুণদের এই আয়োজন মনে করিয়ে দিচ্ছে, আশা শেষ হয়ে যায়নি। আনন্দের আলোও গভীর অর্থ পায়, যখন তা ভাগ হয় যন্ত্রণার আঁধারের মাঝে। তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ভিড় করছেন এই পূজামণ্ডপে।