মতামত

যেমন ছিল মদিনার ইসলাম

ইতিহাসের পরিক্রমায় এমন কিছু শহর আছে যেগুলো শুধু ভৌগোলিক স্থান নয়, বরং মানবসভ্যতার নৈতিক দিকনির্দেশক হয়ে উঠেছে। সপ্তম শতাব্দীর মদিনাতুন নবী বা মদিনা মুনাওয়ারা এমনই এক শহর, যেখানে আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামি সভ্যতা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তব ভিত্তি স্থাপন করেন।

মক্কায় তেরো বছরব্যাপী দাওয়াত, নির্যাতন ও সামাজিক বয়কটের পর যখন তিনি হিজরত করে ইয়াসরিবে (মদিনা) আগমন করেন, তখন ইসলামের রূপ আর শুধু একটি আধ্যাত্মিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার বাস্তব রূপরেখা লাভ করল।

হিজরতের প্রেক্ষাপট

মক্কায় মুসলমানরা চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল। তৎকালীন কুরাইশদের অন্যায় আচরণ, অর্থনৈতিক অবরোধ ও ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের নিয়ে ইয়াসরিবে হিজরতের নির্দেশ দেন। আনসার গোত্রের প্রতিনিধি দল আকাবায় আল্লাহর রাসুলের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে বলেন, ‘আমরা আপনাকে নিজের জীবনের মতো রক্ষা করব।’ [ইবনে হিশাম, সীরাতুন নবী, খণ্ড ২] এই প্রতিশ্রুতি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনার এক মৌলিক পদক্ষেপ ছিল।

মদিনা সনদ: ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি

মদিনায় এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন তা হলো বিভিন্ন গোত্র, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে একটি লিখিত চুক্তি প্রণয়ন। এটি ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ (Constitution of Medina) নামে পরিচিত। এই সনদে মোট ৪৭টি ধারা ছিল, যেখানে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য- ১. ধর্মীয় স্বাধীনতা: প্রত্যেক সম্প্রদায় তাদের ধর্মাচার স্বাধীনভাবে পালন করতে পারবে। ২. সামাজিক ঐক্য: মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রসমূহকে ‘উম্মতে ওয়াহিদাহ’ (একক জাতি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৩. ন্যায়বিচার: বিরোধের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল চূড়ান্ত সালিশ হবেন। ৪. সম্মিলিত প্রতিরক্ষা: মদিনার ওপর আক্রমণ হলে সবাই মিলে প্রতিরোধ করবে। ৫. আন্তঃসম্পর্ক: রক্তপণ, আশ্রয় ও নিরাপত্তা- সবই পারস্পরিক দায়িত্বের মধ্যে থাকবে। এভাবেই আল্লাহর রাসুল মদিনাকে একটি নাগরিক চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্রে পরিণত করেন, যা আধুনিক সাংবিধানিক ধারণার পূর্বসূরি। [ইবনে ইসহাক, সীরাতুন নবী, পৃষ্ঠা ৫০১-৫০৩]

মদিনার সমাজব্যবস্থা

মদিনার ইসলামি সমাজ ছিল ঈমান, ইবাদত ও নৈতিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজকে তিনটি স্তরে পুনর্গঠন করেন- ১. ঈমান ও নৈতিকতা: আল্লাহর একত্ব ও নবীপ্রেমে গঠিত বিশ্বাস সমাজে নৈতিক শক্তি সঞ্চার করে। আল্লাহর রাসুল বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যার চরিত্র সর্বোত্তম।’ [বুখারি, হাদিস ৬০৯৮] মিথ্যা, প্রতারণা, অন্যায়- এসব সমাজ থেকে দূর করতে তিনি নৈতিক শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে পরিণত করেন। ২. ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা: হিজরতের পর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তা মানব ঐক্যের অনন্য নজির। আল্লাহর রাসুল ৯০ জন সাহাবিকে জোড়ায় জোড়ায় ভাই হিসেবে ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা বাস্তব রূপ পায়। [ইবনে সা’দ, তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড ২] ৩. অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি: মদিনায় আল্লাহর রাসুল প্রথমেই সুদের প্রথা নিষিদ্ধ করেন। [সুরা বাকারা: আয়াত ২৭৫-২৭৯] জাকাত প্রবর্তন করে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করেন। ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন, ‘জাকাত মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে।’ [আল-উম্ম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩১২]

তিনি দাসপ্রথা বিলোপে উদ্যোগ নেন, দাসমুক্তিকে ইবাদতের অংশ করেন এবং শ্রমের মর্যাদা ঘোষণা করেন।

বিচার ও প্রশাসনিক কাঠামো

মদিনার রাষ্ট্র ছিল ন্যায়বিচারনির্ভর। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী, আপনি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার করুন।’ [সুরা নিসা: আয়াত ৫৮] ইতিহাসবিদ আল-তাবারি তারীখুর রুসুল ওয়াল মুলুকে উল্লেখ করেন, আল্লাহর রাসুল প্রশাসনিকভাবে মদিনাকে উপজাতি ভিত্তিক দায়িত্বে ভাগ করেন। প্রতিটি গোত্রের প্রতিনিধি ছিলেন প্রশাসনিক উপদেষ্টা। শুরা (পরামর্শ) নীতি ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি। কুরআনুল কারিমে বলা হয়, ‘তাদের কাজ পরস্পর পরামর্শের মাধ্যমে হয়।’ [সুরা আশ-শুরা : আয়াত ৩৮] এই শুরা নীতি পরবর্তীকালে খলিফা উমর রা.-এর আমলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি

মদিনা রাষ্ট্র শুধু অভ্যন্তরীণ প্রশাসনেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিরও সূচনা করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরি ৬ সালের দিকে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী অমুসলিম রাজা-বাদশাহর কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি আক্রমণের পথ বেছে নেননি। যেমন- হিরাক্লিয়াস (রোমান সম্রাট), খসরু পারভেজ (পারস্য সম্রাট), নাজ্জাশি (হাবশার রাজা), মুকাওকিস (মিসরের শাসক) প্রমুখ।

এই চিঠিগুলোতে তিনি লিখেছিলেন- ‘আমি আপনাদের এমন কথায় আহ্বান করি, যা আমাদের ও আপনাদের মধ্যে সমান, যে আমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করব।’ [সুরা আলে ইমরান: আয়াত ৬৪] এই কূটনীতির মধ্য দিয়েই ইসলাম মানবতার শান্তিপূর্ণ বার্তা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়।

যুদ্ধনীতি ও শান্তির দর্শন

মদিনার ইসলামি রাষ্ট্র কখনও আগ্রাসনের পথ বেছে নেয়নি। বরং আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধের অনুমতি দেয়। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো, কারণ তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে।’ [সুরা হজ: আয়াত ৩৯] বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানদের উদ্দেশ্য ছিল ন্যায় প্রতিষ্ঠা, প্রতিশোধ নয়। যুদ্ধের সময় নারী, শিশু, অমুসলিম ও গাছপালা ধ্বংসের নিষেধাজ্ঞা ছিল। [আবু দাউদ, হাদিস ২৬১৩] এমন মানবিক যুদ্ধনীতি আজকের জেনেভা কনভেনশনের অনেক আগেই প্রবর্তিত হয়েছিল।

নারী ও সামাজিক ন্যায়বিচার

মদিনার ইসলামি রূপরেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠা। নারীকে উত্তরাধিকার, শিক্ষা ও মতামত প্রদানের অধিকার দেওয়া হয়। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পুরুষের যেমন অধিকার, তেমনি নারীরও অধিকার রয়েছে।’ [সুরা বাকারা: আয়াত ২২৮] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।’ [তিরমিজি, হাদিস ১১৬২] এভাবে মদিনার সমাজে নারী প্রথমবারের মতো মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে স্থান পায়।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মসজিদে নববী

মদিনার ইসলামি সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মসজিদে নববী। এটি শুধু নামাজের স্থান ছিল না; এখানেই শিক্ষা, বিচার, দাওয়াত, পরামর্শ ও সমাজকল্যাণের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জ্ঞান অর্জনের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর দীনি জ্ঞান অর্জন করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।’ হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ সাহাবি এখানে জ্ঞানচর্চার ভিত্তি রচনা করেন।

নৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসন

মদিনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রমাণ করেন যে প্রকৃত নেতৃত্ব হলো দায়িত্ব, মর্যাদা নয়। তিনি বলেন, ‘নেতৃত্ব একটি আমানত, কেয়ামতের দিন এর হিসাব দিতে হবে।’ [বুখারি, হাদিস ৭১৩৮] তাঁর শাসনে ছিল না রাজপ্রাসাদ, কোনো বিলাসিতা; বরং ছিল আত্মত্যাগ, সেবাপ্রবণতা ও মানবতার দৃষ্টান্ত। এই নৈতিক নেতৃত্বই ইসলামি শাসনের প্রকৃত রূপরেখা।

ফলাফল ও ঐতিহাসিক প্রভাব

মদিনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ১০ বছরের শাসনে এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। দারিদ্র্য প্রায় নির্মূল হয়, অপরাধের হার কমে যায়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে নবজাগরণ ঘটে। এই মদিনার মডেলই পরবর্তীকালে খেলাফতে রাশেদা যুগে বিস্তৃত হয়ে ইসলামি সভ্যতার সোনালি অধ্যায়ে রূপ নেয়।

শেষ কথা হলো, মদিনার ইসলাম মানব ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। এটি প্রমাণ করে, ইসলাম শুধু নামাজ ও রোজার ধর্ম নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক, নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। মদিনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে রূপরেখা স্থাপন করেছিলেন, তা আজও মানবতার জন্য দিকনির্দেশক। যদি বিশ্ব আবার সেই মদিনার আদর্শে ফিরে আসে, তবে অন্যায়, হিংসা ও বৈষম্যের অন্ধকার দূর হয়ে মানবতা আবারও আলোয় ভরে উঠবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম; পরিচালক, সম্পাদনা কেন্দ্র