২০০৫ সাল। লর্ডসের ড্রেসিংরুমে কোণে বসে এক ‘পুচকে’! ততদিনে মোহাম্মদ আশরাফুল দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা। খালেদ মাসুদ পাইলট দলের সেরা উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান। লর্ডসে তাদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করতে আসলেন মুশফিকুর রহিম। বয়স ষোলো। সেদিনের সেই ‘পুচকে’ বুধবার বাংলাদেশের জার্সি গায়ে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০তম টেস্ট খেলতে যাচ্ছেন।
ওই সফরের আগে মুশফিকুর সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না আশরাফুল, পাইলটের। ২০০৪ সালে টন্টনে একটি অনুর্ধ্ব-১৯ টেস্টে মুশফিকুরের করা ৮৮ রানের ইনিংস পরের বছর সিনিয়র দলের সফরে তার নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করে। সেই সফরে প্রস্তুতি ম্যাচেও তার পারফরম্যান্স ছিল অসাধারণ। সাসেক্সের বিপক্ষে ১৮ ও ৬৩ এবং নর্থহ্যাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে ১১৫ রান করে অপরাজিত ছিলেন। লর্ডসে প্রথম একাদশে জায়গা পেতে আর কোনো সমস্যাই হয়নি।
লর্ডসের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেক হয়ে যায় মুশফিকুরের। সেই শুরু। দুই দশক কাটিয়ে মুশফিকুর এখন সেঞ্চুরির ল্যান্ডমার্কে। সেদিনের ড্রেসিংরুমে থাকা আশরাফুল ও পাইলট মুশফিকুরের লম্বা ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বললেন রাইজিংবিডির সঙ্গে…
মোহাম্মদ আশরাফুল
ব্যাটিং কোচ বাংলাদেশ জাতীয় দল
‘‘মুশফিকুর একজনই। বাংলাদেশ ক্রিকেটে দ্বিতীয় আরেকজন আসবে না। এতো নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেটের জন্য, এতো ভালোবাসা এই খেলাটায়…যেটা অন্য কেউ এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। দিনের পর দিন একই মনোযোগ, একই ছন্দ, একই মানসিকতা, একই ভাবনা, গভীরতা বাড়ানো, দায়িত্ব নেওয়া…মুশফিকুর করে দেখিয়েছেন। সেজন্য স্যালুট।’’
‘‘আমিও যখন ক্রিকেটার ছিলাম তখন স্বপ্ন দেখতাম একশ টেস্ট খেলবো। আমি নিশ্চিত যারা টেস্ট খেলেছে সবাই একই স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু কেউ মুশফিকুর রহিমের আগে পারেনি। নানা কারণে পারেনি। মুশফিকুর ভাগ্যবান, সেই সঙ্গে নিজেকে ওই পর্যায়ে নিয়ে গেছে বলেই করতে পেরেছে। আশা করছি একশরও পরও খেলা চালিয়ে যাবে।’’
‘‘প্রচুর আবেগী ছেলে। রান না করলে মন খারাপ করে। আমরা কি করতাম, আজ না পারলে কালকের জন্য অপেক্ষা করতাম। মুশফিকুর আজকে কেন পারল না এটা নিয়ে বসে থাকত। যতক্ষণ না পর্যন্ত মন নরম হতো ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে গুটিয়ে রাখতো। যখন তাকে অধিনায়কত্ব দেওয়া হলো তখন তো ভয়-ই পেয়ে যায়। এতো আবেগী ছেলে কি পারবে? অথচ তার নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কায় ১০০তম টেস্ট জিতলাম। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে হারালাম।’’
‘‘মুশফিকুর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। এখানে আমি তামিমকে সবার ওপরে রাখবো। এরপর মুশফিকুর। তাকে আমি সব সময় মূল্যায়ন করি একজন আদর্শ ক্রিকেটার। যাকে দেখে শেখা উচিত। যাকে অনুসরণ করা উচিত। হ্যাঁ, যদি মুশফিকুর রহিমের মতো পরিশ্রম করতে পারো তাহলে একদিন বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতে পারবে। অনেকের প্রতিভা থাকে। কিন্তু পারে না। কেন পারে? সেই উত্তরটা মুশফিকুর রহিম হতে পারে।’’
‘‘একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে। ২০০৭ বিশ্বকাপে যেটায় আমি ৮৭ করে ম্যাচ জেতাই। ওই ইনিংসে আমি রান আউট হতে পারতম। কিন্তু মুশফিকুর নিজের উইকেট স্যাক্রিফাইস করেছিল। ও বলেছিল, আপনি শেষ করে আসেন। কেন যেন ও-রও সেদিন মনে হয়েছিল আমি পারবো। আমার টাইমিংগুলো ভালো হচ্ছিল। পার্টনার হিসেবে এমন বিশ্বাস রাখতে পারা কিন্তু অনেক বড় বিষয়। এটা গেম অ্যাওয়ারনেস বলতে পারেন। যেটা ওই শুরুর সময় থেকেই ছিল ওর।’’
খালেদ মাসুদ পাইলট
বিসিবি পরিচালক ও সাবেক অধিনায়ক
‘‘একটু মজা করেই বলি, মুশফিকুর ছোটবেলায় খুব কিউট ছিল। লর্ডসে ওকে দেখলাম একেবারে কৈশোর সবেমাত্র পেরিয়েছে। চেহারাতে একটা মায়া। ড্রেসিংরুমে নাড়াচাড়া কম করছে। নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রাখছে। প্যাডের যত্ন করছে। ব্যাট ঠিকঠাক সোজা রাখছে। আমরা ততদিনে অনেক সময় ড্রেসিংরুমে কাটানো নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো। মুশফিকুর নতুন একটি ছেলে এসেছে মাত্র। একটু জড়তা থাকলেও মাঠে নামার পর সব উধাও। তখন আমাদেরই একজন সে। ফিল্ডিং করছে। বল কুড়াচ্ছে। আমাকে মারছে। বোলারের কাছে যাচ্ছে।’’
‘‘শুরুতে ও শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেই খেলেছে। স্পেশাল ব্যাটসম্যান। আমাদের ধারনা ছিল ও শুধু ব্যাটিংটাই পারে। পরে শুনেছিলাম বিকেএসপিতে উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রায়ারে টিকেছিল। তবে আমি যত দিন ছিলাম ততদিন সে ফিল্ডার হিসেবেই খেলেছে। আমি অবসর নেয়ার পর তার উইকেট কিপিং ক্যারিয়ার শুরু হয়। এরপর তো লম্বা সময় টেস্টে কিপিং করলো। কিপিংয়ে উন্নতি করার পরই দায়িত্বটা পেয়েছে। শুরুতে অতো ভালো কিপার কিন্তু ছিল না।’’
‘‘মুশফিকুর রহিম চেয়েছে বলে তার ক্যারিয়ার লম্বা হয়েছে। তার ওই ইচ্ছা শক্তিটা ছিল। তার চেয়ে তো প্রতিভাবান ক্রিকেটে বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু ওই তাড়না কেউ তো দেখাতে পারেননি। এজন্য ওকে সবার চেয়ে এগিয়ে রাখতে হবে।’’
‘‘শততম টেস্ট খেলবে এটা তো বিরাট অর্জন। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশ থেকে। কারণ আমরা এমনিতেই তো আগে টেস্ট কম পেতাম। এখনই না একটু বেশি খেলি। আমার গ্যাপও হয়ে যায়। দুই ফরম্যাট থেকে অবসর নেওয়ায় এখন একটিতেই খেলছে। অনেক দিন পরপর তার ব্যাটিং দেখা যায়। আমি চাই ও এই টেস্টেও যেন একটা ভালো ইনিংস খেলে। সেটা বড় হলে আরো ভালো লাগবে। একশ হলে তো কথাই নেই।”’
‘‘আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকে লম্বা করতে হলে সবার আগে দরকার সুশৃঙ্খল জীবনযাপন। মুশফিকুরকে যারা ১০০ টেস্ট খেলতে দেখছে এখন, যাদের ৫০-৬০টা টেস্ট আছে, তারা যেন অন্তত চায় মুশফিকুরকে ছাড়িয়ে যেতে। যেমন, মিরাজ, লিটন, শান্ত, মুমিনুলরা। তাহলে ওদের দেখাদেখিও বাকিরা আসবে। মুশফিকুর সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সেটা যেন এমন একটা জায়গায় নিয়ে যায় সে, গর্ব করে যেন বলতে পারে আমাদের দেশের একজন ওখানে গিয়েছে।’’
‘‘মুশফিকুর নিজের ইচ্ছা মতো খেলুক। যতদিন চায় ততদিন। ওর অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ ক্রিকেটে প্রয়োজন। আমি চাই, ও যখন বিদায় জানাবে এরপর বাংলাদেশ ক্রিকেটে ওর সময়টা যেন দেয়। ওর ক্রিকেট মস্তিষ্ক আমাদের প্রয়োজন।’’