সারা বাংলা

বগুড়ার হাটে-বাজারে নবান্নের মাছের মেলা

নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে বগুড়ার কয়েকটি উপজেলায় বসেছে মাছের মেলা। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) সকাল থেকেই মেলাগুলোতে বিক্রেতারা তাদের দোকান বসিয়েছেন। ক্রেতারাও ভিড় করছেন মেলা থেকে পছন্দের নানা পদের মাছ কেনা জন্য।

জানা গেছে, প্রতি বছরের ১৮ নভেম্বর উপজেলাগুলোতে এভাবে মাছের মেলার আয়োজন করা হয়। এ প্রথা চলে আসছে প্রায় ২০০ বছর ধরে; ইংরেজ শাসনামল থেকে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত মেলা বসে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলীতে।

উথলী মেলায় প্রতি বছর এই একদিনে কয়েক কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। এবার মেলায় ২ হাজার মণের বেশি মাছ আমদানি হয়েছে, যার আনুমানিক বাজার মূল্য সাড়ে ৫ কোটি টাকা।

ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদার বুৎসিংহের কাছে স্থানীয়রা দাবি করেন একটি হাট স্থাপনের। প্রজাদের কথা শুনে জমিদার প্রায় ৫২ বিঘা জমি হাটের জন্য দান করেন। সেই থেকে স্থানটিতে নবান্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

নবান্ন উৎসব ঘিরে জেলার উথলী, রথবাড়ী, ছোট ও বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, আকনপাড়া, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদেনীপাড়া, বাকশন, গণেশপুর, রহবল শিবগঞ্জসহ অন্তত ২০ গ্রামের মানুষ তাদের বাড়িতে করেছেন বিভিন্ন আয়োজন। মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করেছেন তারা। দূর-দূরান্ত থেকে সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসা আত্মীয়স্বজনের ভীড়ে গ্রামগুলোতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।

সরেজমিন দেখা যায়, ভোরেই মেলায় বড় মাছ নিয়ে হাজির হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রায় ২০০ দোকানের মধ্যে অর্ধেকের বেশি দোকানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পসরা নিয়ে বসেছে ব্যবসায়ীরা। এবার মেলায় দেশীয় জাতের নদীর মাছ তুলনামূলক কম ছিল।

বড় আকৃতির রুই, কাতলা ও চিতল ৬০০–৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও মাঝারি মাছ ৪০০–৫৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। ব্রিগেড ও সিলভার কার্পের দাম ৫০০–৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।

মাছ ছাড়াও মেলায় নতুন আলু, কেশর, মিষ্টি আলু উঠিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া মেলায় বসেছে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, জিলাপি, দইসহ খাবারের দোকান। পাশাপাশি মাটির তৈজসপ্রত্রসহ ছোট বাচ্চাদের খেলনার দোকান নিয়ে হাজির হয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

মেলায় আসা গুজিয়ার ওয়াসিম বলেন, “মেলাটা উথলীতে হলেও মেলার জন্য তাদের গ্রামেও অনেক আয়োজন থাকে। প্রতিটি বাড়িতে এদিন আত্মীয়-স্বজনের হিড়িক পড়ে যায়। আনন্দ করে সকলে। খাবার-দাবার প্রচুর কেনা হয়। যেমন- আমাদের বাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজন এসেছেন।”

তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত আটজন আত্মীয় এসেছেন, সন্ধ্যার মধ্যে আরো আসবে। আমি ৫ কেজি ওজনের সিলভার কার্প মাছ কিনলাম। এটা ডাল দিয়ে ঘাটি করবে। মিষ্টি কিনেছি, দই কিনেছি কয়েক হাড়ি। এগুলো দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে অতিথিদের।”

উথলী গ্রামের আব্দুল মতিন বলেন, “মেলাটি অনেক পুরনো। মেলাকে ঘিরে আমাদের লোকজন প্রায় কয়েক মাস আগে থেকেই আর্থিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকে কেনাকাটা করার জন্য। মেলায় মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দেওয়া হয়। প্রতিটি বাড়িতেই মেহমান দিয়ে ভরপুর থাকে। একেকটি পরিবারের এ মেলায় খরচ অন্তত ৫ হাজার টাকা। অনেকে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকাও খরচ করে। যার বাড়িতে যেমন মেহমান আসে, তার বাড়িতে তেমন খরচ।”

বিক্রেতা আনারুল ইসলাম জানান, পাইকারি বাজারে দাম বাড়ায় খুচরা বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এবার ৫ মণ মাছ তুলেছি, আশা করছি লাভ ভালো হবে।

মাছ ব্যবসায়ী উজ্জ্বল জানান, তিনি ২ লাখ টাকার মাছ এনেছেন। গতবারের তুলনায় এবার মাছের দাম একটু বেশি। তবুও বিক্রি বেশ ভালো হচ্ছে।

মাছ বিক্রেতা নারায়ণপুর গ্রামের আব্দুল ওয়াহাব জানান, মেলায় ছোট-বড় মিলে শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা অন্তত ৫ থেকে ১০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য সেখানে রাত থেকে ২০টি আড়ৎ খোলা হয়। সেসব আড়ৎ থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।

উথলী হাটের ইজারাদার বুলবুল ইসলাম বলেন, “এবার মাছের আমদানি বেশি হয়েছে; ২ হাজার মণের বেশি হবে। এই একদিনে মেলা উপলক্ষে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা লেনদেন হবে।”

এদিকে, নবান্ন উৎসব উপলক্ষ্যে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে মাছের মেলা বসেছে।

নন্দীগ্রামের বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, “সকাল থেকেই নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ড, ওমরপুর, রণবাঘা হাটসহ আরো কয়েকটি স্থানে মাছের মেলা বসেছে। মাছের পাশাপাশি মিষ্টির দোকান, নতুন আলুসহ সবজির দোকানও বসেছে। প্রতি বছরই এই নির্দিষ্ট দিনে মেলাটি হয়ে থাকে। এভাবে অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে।” নবান্ন উপলক্ষে হওয়া এ মেলা তার দাদাদেরও পূর্ব পুরুষদের আগে থেকে হয়ে আসছে বলে জানান তিনি।

একইভাবে মেলা বসেছে বগুড়ার শেরপুর, শাজাহানপুর এবং কাহালু উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে।