ইতিহাসের অক্ষয় কালিতে লিখা হয়ে গেছে মুশফিকুর রহিমের নাম। ভারতের সুনীল গাভাস্কার, পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াদাদ, শ্রীলঙ্কার সনাৎ জয়াসুরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার অ্যালান বোর্ডার, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্লাইভ লয়েড প্রত্যেকে নিজেদের দেশের হয়ে প্রথম শততম টেস্ট খেলেছেন। মুশফিকুর সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরে মাঠে নেমে।
এছাড়া শততম টেস্টে মাঠে নেমে সেঞ্চুরির তালিকাতেও নাম লিখিয়েছেন তিনি। রিকি পন্টিং, মিয়াদাদ, ইনজামাম নিজেদের শততম টেস্ট সেঞ্চুরিতে রাঙিয়েছেন। ১০৬ রানের ইনিংস খেলে এলিট এই ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন মুশফিকুর।
বরাবরই টেস্টের প্রতি মুশফিকুরের ভালোবাসা থাকে অত্যাধিক। ২০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্যবার টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার কথা বলেছেন। বিরাট অর্জনের দিনে আরো একবার সেই কথা মনে করিয়ে দিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সুপারস্টার, ‘‘যদি তিনটা ফরম্যাটের মধ্যে কোনো একটা ফরম্যাট বেছে নিতে বলেন, টেস্ট ক্রিকেট দ্যাটস মাই আল্টিমেট গোল এবং আমি যতদিন পারব চেষ্টা করব টেস্ট ক্রিকেটে যেন খেলে যেতে পারি এবং সবার শেষে আমি টেস্ট ক্রিকেটটা ছাড়তে চাই।”
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এই টেস্টের পর তাকে চার মাস অপেক্ষায় থাকতে হবে। ঘরের মাঠে মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানকে আতিথেয়তা দেবে বাংলাদেশ। মুশফিকুরকে পরের আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
২০ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে পাওয়া, না পাওয়ার অনেক আক্ষেপ আছে মুশফিকেরও। তবে ক্যারিয়ার যখন থেমে যাবে, নিজের ব্যাট-প্যাড যেদিন তুলে রাখবেন সেদিন অন্তত দলকে সেরা ছয়ে দেখতে চান। সেই কথাই বললেন তিনি, ‘‘মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। টেস্ট ক্রিকেটে এত বছর খেলার পর আমার একটা ইচ্ছা আছে যে, আমি যখন খেলাটা ছেড়ে দেব, অন্তত বাংলাদেশ যেন টপ সিক্সের মধ্যে থাকতে পারে। এটা আমার অন্যতম একটি লক্ষ।’’
মুশফিকুর একশ টেস্ট খেলছেন কিংবা খেলার প্রক্রিয়াতে আছেন তা বিশ্বাস হচ্ছিল না তারও, ‘‘আমি নিজেও আসলে বিশ্বাস করতে পারি না, বাংলাদেশের একজন খেলোয়াড় একশ টেস্ট খেলবে। নিশ্চিতভাবেই এটা বিরাট অর্জন। শুধু আমার জন্য নয়, এটা যেকোনো ক্রিকেটার, যেকোনো দেশের জন্য গর্বের মুহূর্ত। এজন্য ভালো লাগছে সেই ব্যক্তিটি আমি হতে পেরেছি।’’
যে কোনো কিছুতে প্রথম হওয়ার একটা বাড়তি দায়িত্ব থাকে। সেই দায়িত্বটা হচ্ছে বাকিদের পথ দেখানো। বাকিদের অনুপ্রাণিত করা। নিজেকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেন বাকিরা ওই চূঁড়ায় উঠতে পারে। মুশফিকুরও নিজেও সেই দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত, ‘‘আমার উপর দায়িত্বটা অন্যরকম বেশি। আর যে কয়টা ম্যাচ হয়তো যেভাবেই খেলতে পারি, চেষ্টা থাকবে যেন সেটার প্রতিফলন দিতে পারি মাঠে। সাথে সাথে যেন ড্রেসিং রুমের, আমি যাওয়ার পরে এমনও যেন এক-দুইজন খেলোয়াড় দিয়ে রেখে যেতে পারি যেন সেই শূন্যস্থানটা পূরণ হয়ে যায়।’’
ম্যাচের আগে বিসিবির পক্ষ থেকে তাকে সম্মানজনক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তার বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তানরা মাঠে উপস্থিত থেকে মুশফিকুরের শততম টেস্ট ম্যাচের সাক্ষী হয়েছিলেন। বিসিবির এই উদ্যোগে আপ্লুত মুশফিকুর, ‘‘১০০ টেস্ট ইটস হিউজ নাম্বার। এখানে পৌঁছা পর্যন্ত সবকিছু শিখে গেছি আশা করি। বিসিবিকে ধন্যবাদ তারা আমার জন্য যে পরিকল্পনা করেছিল। এটায় আমি গর্ব এবং বিশেষ কিছু অনুভব করেছি। আমি মনে করি এই স্বীকৃতি বাকিদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আমার পর যারা ১০০ টেস্ট খেলবে তাদের জন্যও এটা অনুপ্রেরণার।’’
২০ বছরে ১০০ টেস্ট ১৩ সেঞ্চুরি…কতটা প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছেন মুশফিকুর? উত্তরটা তার মুখ থেকেই শুনুন, ‘‘প্রত্যেকটা ম্যাচেই আমার চেষ্টা থাকে যে, আমি যেন আমার সেরাটা দিতে পারি। দলের জন্য অবদান রাখতে পারি। আমার কাছে দল আছে। দলের জন্য অবদান আগে। বাংলাদেশের জন্য আমি মুশফিকুর রহিম, একটা সমুদ্রের দুই-একটা ফোঁটা পানি ফোঁটা। বাংলাদেশ সবসময় প্রথম। ভালো লেগেছে যে একটা কিছুটা অবদান রাখতে পেরেছি।’’
গতকাল ৯৯ রানে অপরাজিত ছিলেন মুশফিকুর। ওই সময়ে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়া তীব্র যন্ত্রনার। সেঞ্চুরি ছুঁতে না পারার শূন্যতাও কাজ করে। ঠিক ওই মুহূর্তে তিনি কী ভাবছিলেন? জানতে চাইলে বলেছেন, ‘‘চেষ্টা তো করছিলাম গতকাল যেন হয়ে যায়। মাইলফলক ছোঁয়া সহজ বিষয় নয়। তারপরও ৯৯ রানে থেকে অপরাজিত থাকা এটাও প্রথম অভিজ্ঞতা।’’
সবশেষে মুশফিকুর মুখ খুলেছেন নিজের একাগ্রতা, নিবেদন ও তাড়নার কথা জানাতে গিয়ে, ‘‘আমার কাছে পেশাদারিত্বের কোনো ছাড় নেই। আমি ১০০ করি বা জিরো করে আউট হই, এটা আমার হাতে নেই। আমার হাতে যেটা আছে চেষ্টা, অনুশীলন প্রক্রিয়া এবং সততা। শুধু ক্রিকেটে নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। আমি ওখানে যে কথাটা বলেছিলাম একশতম টেস্ট খেলার আগে…আমার কাছে মনে হলো আমি নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে যাচ্ছি। আমি ওই পরিমাণে আগ্রহ এবং রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষা করেছি। প্রতিটি ম্যাচ বিশেষ কিছু এবং প্রতিটি ম্যাচে আমি যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করি। আমি একমাত্র এটাই করতে পারি।’’