ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে কিয়েভের মিত্ররা উদ্বেগ প্রকাশ করার পর, প্রস্তাবিত শান্তি চুক্তি কিয়েভের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তাব নয় বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
রবিবার (২৩ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সপ্তাহে ইউক্রেন বা এর ইউরোপীয় মিত্রদের ছাড়াই মার্কিন ও রুশ কর্মকর্তারা প্রস্তাবটির খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন।
শনিবার ইউরোপ, কানাডা ও জাপানের নেতারা বলেন, মার্কিন শান্তি পরিকল্পনায় ‘ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তির জন্য প্রয়োজনীয়’ উপাদান রয়েছে, কিন্তু এতে অনেক পরিমার্জনা প্রয়োজন। তারা ইউক্রেনের সীমান্ত পরিবর্তন ও সেনাবাহিনীর আকার কমানোর শর্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এর আগে সতর্ক করে বলেছিলেন যে, মস্কোর পক্ষে অনুকূল হিসেবে বিবেচিত পরিকল্পনাটি গ্রহণের জন্য মার্কিন চাপের কারণে ইউক্রেন ‘ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটির’ সম্মুখীন হচ্ছে।
ট্রাম্প ২৮-দফা পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য ইউক্রেনকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, মার্কিন পরিকল্পনাটি ইউক্রেনে শান্তি স্থাপনের একটি ‘ভিত্তি’ হতে পারে।
স্থানীয় সময় শনিবার হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হয়, প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটি ইউক্রেনের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তাব কিনা? জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “না, এটি আমার চূড়ান্ত প্রস্তাব নয়।”
তিনি আরো বলেন, “যেভাবেই হোক আমাদের (যুদ্ধ) শেষ করতে হবে, আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি।”
রবিবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে। এই আলোচনায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফও অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে শনিবার জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকে ইউক্রেন ইস্যুতে বৈঠকে বসেন কানাডা, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং নরওয়ের নেতারা। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া শান্তি পরিকল্পনাটি এমন একটি ভিত্তি, যাতে অতিরিক্ত পরিমার্জন প্রয়োজন। ভবিষ্যতের শান্তি টেকসই নিশ্চিত করার জন্য আমরা জড়িত হতে প্রস্তুত। আমরা এই নীতিতে স্পষ্ট যে, বল প্রয়োগের মাধ্যমে সীমান্ত পরিবর্তন করা উচিত নয়।”
বিবৃতিতে বলা হয়, “ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর আকার কমানোর প্রস্তাবনা নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন, যা ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে আক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলবে।"
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো সম্পর্কিত উপাদানগুলো বাস্তবায়নের জন্য যথাক্রমে ইইউ ও ন্যাটো সদস্যদের সম্মতি প্রয়োজন হবে।”
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার শনিবার জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন, এরপরে ট্রাম্পের সঙ্গেও একটি ফোনালাপ হয়েছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপের বিষয়ে ডাউনিং স্ট্রিটের একজন মুখপাত্র জানান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আজ জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং অংশীদারদের (ইউক্রেনের মিত্রদের) মধ্যে যে আলোচনা চলছে তা নিয়ে কথা বলেছেন।
তিনি আরো বলেন, “নেতারা রবিবার জেনেভায় ২৮-দফা মার্কিন শান্তি প্রস্তাবে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়েছেন। তারা রবিবার আবার বৈঠকে বলতে রাজি হয়েছেন।”
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, তিনি মার্কিন পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর আকার কমানোর বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
মার্কিন শান্তি পরিকল্পনায় ইউক্রেনীয় সৈন্যদের বর্তমানে দোনেৎস্ক অঞ্চলের যে অংশগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেখান থেকে প্রত্যাহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রত্যাহার করা অঞ্চলটিকে একটি নিরপেক্ষ অসামরিকীকৃত বাফার জোন হিসেবে গণ্য করা হবে, যা আন্তর্জাতিকভাবে রাশিয়ান ফেডারেশনের অংশ হিসেবে স্বীকৃত হবে। এটি একটি ২৮-দফা প্রস্তাবের অংশ, যেখানে ইউক্রেনকে তাদের সামরিক সক্ষমতা কমাতেও বলা হয়েছে।
মার্কিন শান্তি পরিকল্পনায় প্রস্তাব করা হয়েছে যে, ইউক্রেনীয় সৈন্যদের পূর্ব দোনেৎস্কের কিছু অংশ থেকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং এই অঞ্চলসহ লুহানস্ক ও ২০১৪ সালে রাশিয়ার সংযুক্ত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে থাকবে। এটি একটি ২৮-দফা প্রস্তাবের অংশ, যেখানে ইউক্রেনকে তাদের সামরিক সক্ষমতা কমাতেও বলা হয়েছে।
পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, এর বিনিময়ে কিয়েভ ‘নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা গ্যারান্টি’ পাবে, যদিও কোনো বিবরণ দেওয়া হয়নি। এতে আরো বলা হয়েছে, রাশিয়া তার প্রতিবেশীদের আক্রমণ করবে না এবং ন্যাটোতে যোগদান স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হবে।
শুক্রবার ট্রাম্প বলেছিলেন যে, জেলেনস্কিকে মার্কিন প্রস্তাব মেনে নিতে হবে। অন্যথায় ইউক্রেন ও রাশিয়া লড়াই চালিয়ে যাবে।
এর প্রতিক্রিয়ায় জেলেনস্কি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, এটি “আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটি। ইউক্রেনের সামনে একটি বিকল্প রয়েছে-আমাদের মর্যাদা হারানো অথবা একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হারানো।”
জেলেনস্কি বলেন, তিনি কখনোই দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। তবে ইউক্রেন শান্তভাবে এবং দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করবে, যাতে ‘ইউক্রেনের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নেওয়া হয়’।
শনিবার জেলেনস্কি এক ঘোষণায় বলেন, তার অফিস প্রধান আন্দ্রি ইয়েরমাক ভবিষ্যতে একটি শান্তি চুক্তির আলোচনার জন্য ইউক্রেনের আলোচক দলের নেতৃত্ব দেবেন, যার মধ্যে রাশিয়া জড়িত থাকতে পারে এমন যেকোনো চুক্তিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা একটি ভিডিও বিবৃতিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, “আমাদের প্রতিনিধিরা জানেন কীভাবে ইউক্রেনের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হয় এবং রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আরেকটি হামলা চালানো থেকে বিরত রাখতে ঠিক কী করতে হবে।”
কিয়েভ যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত অস্ত্র সরবরাহের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যার মধ্যে রয়েছে মারাত্মক রাশিয়ান বিমান আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ওয়াশিংটনের সরবরাহ করা গোয়েন্দা তথ্য।
শুক্রবার রাশিয়া নিশ্চিত করেছে যে, মার্কিন পরিকল্পনাটি মস্কো পেয়েছে। কিন্তু বলেছে যে, এটি নিয়ে ক্রেমলিনের সঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়নি।
পুতিন বলেছেন, মস্কো ‘নমনীয়তা দেখাতে’ ইচ্ছুক, তবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্যও প্রস্তুত।