আবদুল মান্নান পলাশ
‘মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে আমি আর বাইতে পারলাম না সারা জনম উজান বাইলাম ভাটির নাগাল পাইলাম না।’
আমাদের নদীমাতৃক বাংলার লোকগানের এই পঙ্ক্তি এখনো নদ-নদীর উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভেসে বেড়ায়। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় তার সুর। এ গান যাদের কণ্ঠে মাদকতা ছড়ায় তাদেরই একজন সজীব (১৪)। পেশায় সে মাঝি। তাকে এই সম্প্রদায়ের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি বলা যায়। হয়তো বা শেষ প্রতিনিধিও, কেননা এক সময়ের কত স্রোতস্বিনীই তো এখন মরা খাল!
পাবনার চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে দুই নদী-গুমানী আর করতোয়া। এক পাড়ে ভাঙ্গুড়ার এক সময়ের বিখ্যাত অষ্টমনিয়া হাট। অন্য পাড়ে চাটমোহরের নিমাইচড়ার প্রসিদ্ধ মির্জাপুর হাট। যদিও এখন তা বাজারের মতোই মনে হয়। মির্জাপুর হাটের বাম পাশ ঘেঁষে বয়ে এসে গুমানীতে মিলেছে করতোয়া। হাটের ওপাড়ে করতোয়া-গুমানীর মাঝখানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রাম চিনাভাতকুড়, বিশ্বনাথপুর, বনমালীনগর, বহরমপুরসহ ১২টি গ্রাম। এ এক দরিদ্র জনপদ।
সেই জনপদের বহরমপুর গ্রামের মাঝি সজীব। চাটমোহর থেকে আমরা সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে করতোয়া নদীর ঘাটে সজীবের দেখা পাই। পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কিশোর হাতে বৈঠা ধরে নদীর ওপাড় থেকে নৌকা নিয়ে সে এপাড়ে আসছে। আমার সঙ্গে রাইজিংবিডি.কম-এর জেলা প্রতিনিধি শাহীন রহমান ছিলেন। তিনি বললেন, ভাই, কিশোর এই মাঝিকে নিয়ে একটা ফিচার লিখতে পারেন।
কথাটা আমার মনে ধরল। ঘাটে ভিড়ল সজীবের ছোট্ট ডিঙ্গি। এগিয়ে গেলাম। আমাদের হাতে ক্যামেরা দেখে সজীব কি একটু আরষ্ট হলো? এ অসম্ভব নয়। অনেক বড়দেরও দেখেছি এমন। ওকে স্বাভাবিক করতে নিজেই কথা বললাম। পরিচয় দিলাম। ও কিন্তু যতটা ভেবেছিলাম ততটা সাড়া দিল না। ফ্যাল ফ্যাল করে আমাদের দেখতে লাগল। কথা বলল না। এবার পাশের এক মাঝি ধমকে উঠলেন, ‘এ ছ্যাড়া, কথা কইসনে ক্যা? ছারেরা সুম্বাদিক। ভালো কোরে কথা ক।’
ধমক খেয়েই সম্ভবত সজীব তার সজীবতা ফিরে পেল। জানতে চাইলাম, ‘কেন তুমি মাঝির কাজ করছো?’
‘আমিতো করিনে। ইস্কুলেই পড়ি কিলাস সিক্সে। গরিব মানুষ। তাই যেদিন কিলাস থাকে না, সিদিন আমি নৈকে চালাই। বাজান যায় অন্য কাম কোরবের।’
এটুকু বলেই সজীব দম নেয়। এই বয়সে তার বিষয় বুদ্ধি দেখে আমরাও একটু থামি। সজীবের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তাদের জমি নেই। আছে শুধু বসতভিটা। বড় ভাই সবুজ সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট বোন ফাইজিয়ার বয়স ২ বছর। বাবা ফজের আলী বর্ষাকালে এই ঘাটে নৌকা পারাপারের কাজ করে সংসার টেনে নেন। বাবার কাজে সাহায্য করে সবুজ ও সজীব। বাবা শুকনো মৌসুমে করেন দিনমজুরী। যখন সজীবের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল তখনও তার গায়ে স্কুলের সার্ট। বললাম, ‘এটা পরে রয়েছো কেন?’
‘আর যে পরার কিছু নেই।’ সজীবের ছোট্ট জবাব।
এবার নৌকা থেকে নামবো হঠাৎ সজীব প্রশ্ন করে বসল, ‘এসব জানে, ছবি দিয়ে আপনেরা কী কোরবেন?’
নামতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। ওর দিকে তাকাই। কিন্তু কিছু বলতে পারি না। নিরুত্তর থেকে মাথা নিচু করে নৌকা থেকে নেমে আসি। সামনের দিকে পা বাড়াই। সজীব চেয়ে থাকে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ আগস্ট ২০১৪/তাপস রায়