আইন ও অপরাধ

এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে ১০৭ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং মামলা

পরিবহন সেক্টরে দীর্ঘদিনের চাঁদাবাজি ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের অভিযোগে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এনা ট্রান্সপোর্টের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে ১০৭ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং মামলা করেছে সিআইডি। প্রাথমিক তদন্তে তার বিপুল সম্পদ–অর্জন ও অর্থপাচারের প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

বুধবার (২৬ নভেম্বর) সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো জসীম উদ্দিন খান এ তথ্য জানান।

তিনি জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার প্রমাণ পাওয়ার পর রমনা থানার মামলা করে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট ।

সিআইডি জানায়, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আশির দশকের পরে পরিবহন সেক্টরে যাত্রা শুরু করেন। পার্টনারশিপে একটি পুরাতন বাস কেনার মাধ্যমে তার ব্যবসার সূচনা হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি প্রায় ২০টি বাসের মালিক হয়ে ওঠেন। অল্প সময়েই তিনি পরিবহন মালিকদের সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেন। এরপর তার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাব বাড়িয়ে নেন। প্রথমে বিএনপির রাজনীতি, পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদও লাভ করেন। এই রাজনৈতিক পরিচয় খন্দকার এনায়েত উল্লাহকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতন পর্যন্ত টানা ১৬ বছর তিনি ধারাবাহিকভাবে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি সংগঠনের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং পরিবহন সেক্টরে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল ও অবরোধে পরিবহন সচল রাখার ঘোষণা দিয়ে তিনি সংবাদ শিরোনামে থাকলেও, নিজের কোম্পানির বাসগুলো রাস্তায় নামাতেন না, যা তার কৌশলের অংশ ছিল।

সিআইডি আরো জানায়, এনায়েত উল্লাহ ও তার সহযোগীরা সিন্ডিকেট গড়ে বিভিন্ন অজুহাতে বাস মালিকদের কাছ থেকে প্রকাশ্য চাঁদা আদায় করতেন। দৈনিক চাঁদার পাশাপাশি মাসিক চাঁদাও নেওয়া হতো, এবং নতুন বাস কোনো রুটে নামাতে হলে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা দিতে হতো।  নতুন বাস কেনার সময় মালিকদের সেই বাসের একটি ভাগও এনায়েতকে দিতে বাধ্য করা হতো, না হলে বাসটি সড়কে চলতে পারত না। এর ফলে অনেক কোম্পানি বিক্রির সময় মালিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে চাঁদা পরিশোধ করত।

ঢাকার প্রতিটি বাস টার্মিনাল তার নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং শুধুমাত্র রাজধানী নয়, সারা দেশের বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতিগুলো থেকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করা হতো উল্লেখ করে সিআইডি জানায়, সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী ব্যবহার করে তিনি পরিবহন সেক্টরে ত্রাসের রাজত্ব চালাতেন। বিএফআইইউ , বিভিন্ন ব্যাংক, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্র অফিস,বাংলাদেশ মালিক পরিবহন সমিতি এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদসহ অন্যান্য বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রের উপর ভিত্তি করে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনুসন্ধানকালে ধানমন্ডির ২টি ফ্ল্যাট এবং রূপগঞ্জের ২টি প্লট বিজ্ঞ সিনিয়র স্পেশাল মহানগর জজ আদালত, ঢাকা-এর আদেশে ক্রোক করা হয়, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা, এবং একই আদালতের আদেশে তাদের নামে থাকা ৫৩টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়।

সিআইডির বিশ্লেষণে দেখা যায়, খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ১৯৯টি ব্যাংক হিসাবে মোট জমা হয়েছে প্রায় ২,১৩১ কোটি টাকা, আর উত্তোলন হয়েছে প্রায় ২,০০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে, এনা ট্রান্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের ৪৩টি হিসাবে জমা ৯৩৪.০৪ কোটি টাকা, উত্তোলন ৯০৬.৯৬ কোটি টাকা, এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লি. এর ৮টি হিসাবে জমা ৪১০.৩৮ কোটি টাকা, উত্তোলন ৪০৮.২৫ কোটি টাকা ও খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ব্যক্তিগত ৭৪টি হিসাবে জমা ৪৫৯.০৮ কোটি টাকা, উত্তোলন ৪০২.৭৩ কোটি টাকার তথ্য জানা যায়। সিআইডির বিস্তারিত অনুসন্ধান ফলাফলে দেখা যায়, ‘স্ট্রাকচারিং’ বা ‘স্মার্ট লেয়ারিং’ কৌশল ব্যবহার করে চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অবৈধ অর্থ নানা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে মোট ১০৭ কোটি ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ টাকা মানিলন্ডারিং করা হয়েছে। 

সিআইডি জানায়, অনুসন্ধানে পাওয়া প্রাথমিক সত্যতা বিবেচনায় আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খন্দকার এনায়েত উল্লাহসহ পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করা হয়।