সারা বাংলা

গাইবান্ধায় ১১ মাসে ১৭০ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার

গত ১৮ অক্টোবর জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার কামারপাড়ায় দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে (৮) বিস্কুট দেওয়ার কথা বলে বাড়িতে ডেকে ধর্ষণ করেন আনারুল। পরে শিশুটিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় ২২ অক্টোবর রাতে শিশুটির পরিবার সাদুল্লাপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে। ৩১ অক্টোবর চট্রগ্রাম থেকে আনারুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

১৯ অক্টোবর একই উপজেলার ধাপেরহাট ইউনিয়নে ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধাকে হাত-পা বেঁধে পাশবিক নির্যাতন চালায় প্রতিবেশী দুই সন্তানের জনক আইয়ুব আলী। এ ঘটনায় গুরুতর আহত ওই বৃদ্ধাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন সাদুল্লাপুর থানায় ধর্ষণ মামলা করা হলেও আসামি এখনও গ্রেপ্তার হয়নি।

একই দিন ১৯ অক্টোবর রাতে জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় স্থানীয় যুবদল নেতা মশিউর রহমানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী। তার অভিযোগ, মশিউর রহমান ও তার সহযোগী জব্বারুল ইসলাম এবং আরেক অপরিচিত ব্যক্তি তাকে ধর্ষণ করেছে।

গত ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যারাতেও পলাশবাড়ী উপজেলার বুজরুক টেংরা গ্রামে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। নিজের কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতা সাদেকুল ইসলামকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয়রা। এ ঘটনাতেও হয়েছে ধর্ষণ মামলা। 

এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধারাবাহিকভাবেই ঘটছে এমন পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা। গত বছরের তুলনায় এ বছর ধর্ষণ বেড়েছে। যা সব মহলে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী সংগঠনগুলো বলছে, বিচারহীনতা, মানসিক বিকার এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের হাতে ফোন ও ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারের কারণে নৈতিক স্খলন বাড়ছে।

গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালসহ ৭ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায় গাইবান্ধায় চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ১৭০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫-১৭ বছর বয়সের শিশু ও কিশোরী। এছাড়া  ১৮-৭০ বছর বয়সের ২০ শতাংশ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০২৪ সালে ১৬২ জন নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং ২২২ জন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, যা চলতি বছরের তুলনায় কম।

অভিভাবকরা বলছেন, মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে পরিবারে মানসিক চাপ আগের তুলনায় বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে কাউন্সেলিং প্রয়োজন, যাতে ধর্ষণের কুফল এবং এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সবাই সচেতন থাকতে পারে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গাইবান্ধা শাখার সাধারণ সম্পাদক রিকতু প্রসাদ। তার ভাষ্য, ‘‘আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে প্রকৃত অপরাধীরা সহজে জামিন পেয়ে যায়। অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার কারণেও ধর্ষণ বাড়ছে। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার রীতি চলমান করা গেলেই শুধু ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। সামাজিক সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে।’’

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল গাইবান্ধার প্রোগ্রাম অফিসারের পদ কয়েকমাস ধরে শূন্য। রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন সুপারভাইজার আনন্দ কুমার। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ১৭০ জন নারী শারীরিক এবং ৮ জন নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৮ জন শিশু যৌন নির্যাতনের  শিকার হয়েছে।

আনন্দ কুমার বলেন, ‘‘নির্যাতিতদের দ্রুত চিকিৎসা, আইনি সেবাসহ সব ধরনের সহযোগিতা পেতে দফতরগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে ওসিসি। আমাদের লোকবল মাত্র তিনজন। কাজ করা খুব কঠিন।’’

নারীমুক্তি কেন্দ্র গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক নীলুফার ইয়াসমিন শিল্পী বলেন, ‘‘অপরাধীদের সঠিক বিচার ও কঠিন শাস্তি না হওয়ার কারণে সামজিক অপরাধ বাড়ছে। অপরাধ করার পরও অপরাধীদের যখন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না, তখন অন্যরাও অপরাধ করার সাহস পায়। ফলে দিনদিন ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ করছি, কিন্তু কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না।’’

গাইবান্ধার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শরীফ আল রাজিব (প্রশাসন ও অর্থ) রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তাদের প্রত্যেককে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুধু আইন দিয়ে ধর্ষণ ঠেকানো সম্ভব নয়। সমাজ থেকে ধর্ষণ কমিয়ে আনতে মসজিদ, মন্দির, অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’’