দীপাঞ্চল ভ্রমণ মানেই বিচ্ছিন্ন কোনো ভূখণ্ডে সাগর ও আকাশের দিগন্তরেখায় অর্ধচন্দ্র ডিঙি নৌকার মিলিয়ে যেতে দেখা। যেখানে ঢেউয়ের পিঠে চেপে যাযাবর পলিমাটি ঠিকানা খুঁজে পায় প্রাণবন্ত গ্রামগুলোর কাঁচা সৈকতে। বঙ্গোপসাগরের সংস্পর্শে থাকায় এ দেশের ভ্রমণকারীরাও পরিচিত এমন দৃশ্যের সঙ্গে। তবে দেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ হওয়ার বিশেষত্ব মহেশখালীকে আলাদা করেছে আর সব উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে। শুধুই কি পাহাড়ের চূড়া থেকে পাখির চোখে দ্বীপ দর্শন?
এখানে আছে দেশের অকৃত্রিম সব সৌন্দর্যের উপাদান। কক্সবাজার ভ্রমণের তৃতীয় দিন আমাদের ভ্রমণ গন্তব্য ছিল মহেশখালী। গতদিন রাতঅব্দি ঘুরে বেড়িয়েছি বিভিন্ন গন্তব্যে। তাই ঘুম থেকে উঠতে একটু কষ্ট হয়েছে বৈকি। ঘড়ির কাটায় সকাল সাতটা মোবাইল সাহেবের গর্জনের শব্দে ঘুম থেকে উঠতেই হলো। সকালে হোটেল কর্তৃক প্রদেয় নাস্তা করে তৈরি হয়ে নিলাম নতুন গন্তব্যপানে যাওয়ার নিমিত্তে।
আমরা বেরিয়ে পড়লাম কলাতলী থেকে ব্যাটারিচালিত অটোতে। গেলাম কক্সবাজার ৬ নাম্বার ঘাটে। সেখানে লোকজন যে যার মত গন্তব্য পথে যাচ্ছে, কেউ আবার ফিরছে শহর পানে। আমরা এগিয়ে চললাম, আমি আবার সাঁতার জানি না। তাই নদী পথে যে কোন গন্তব্যে ভীতি কাজ করে আমার। তার মাঝে এবার পাড়ি দিতে হবে সমুদ্র। ও, বলাই হলো না, আমাদের এবারের ভ্রমণ গন্তব্য মহেশখালীতে অবস্থিত আদিনাথ মন্দির।
চারদিকে সাগরবেষ্টিত মহেশখালী দ্বীপের অন্যতম দর্শনীয় স্থান এই মন্দির। কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কি.মি. দূরে আদিনাথ মন্দিরের অবস্থান। মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা ইউনিয়নের ঠাকুরতলা গ্রামে মন্দিরটি অবস্থিত, যা সমুদ্র-সমতল থেকে প্রায় ৮৫.৩ মিটার উঁচুতে। মন্দিরটি মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত, যা সমতল থেকে ৬৯টি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। লোককাহিনী অনুসারে মহেশখালীর মৈনাক পাহাড়ে শিবের আবির্ভাব ঘটে ত্রেতাযুগে।
আগে থেকে অনেকেই বলেছিল, মহেশখালী জেটিতে ওঠা-নামা কষ্টকর; তার প্রতিফলন দেখলাম। বেশ কায়দা করে উঠে পড়লাম স্পীড বোটে। এবার সমুদ্র পাড়ি দেবার পালা। সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে আমাদের বোট এগিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে সমুদ্রের নোনা জল স্পর্শ করছে শরীর। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে আমাদের। ২০ মিনিটের মতো রোমাঞ্চকর সময় পার করালাম আমরা। এরপর পৌঁছে গেলাম।
বেশ উঁচু জেটি। সাগরের পানি বাড়লে যাতে জেটি ডুবে না যায়, সে জন্যই এত উঁচু। জেটিতে দাঁড়িয়ে ডানে-বামে তাকালে দেখা মেলে সবুজ ম্যানগ্রোভ বন। বন কিছুটা সুন্দরবনের মতো দেখতে। এবার ত্রিচক্র যানে এগিয়ে যেতে লাগলাম গন্তব্য পানে। সূর্যদেবের আলোক প্রভার স্পর্শ নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম আদিনাথ মন্দিরের গেইটে।
গেটের বাইরে দুপাশে নানা পণ্যের দোকান। কিছু দোকানের সামনে মাটির পাত্রে লাল জবাফুল, কমলা, শসা, বেল, কলাসহ নানা ফল সাজানো। মূলত মন্দিরে আসা পুণ্যার্থীরা প্রার্থনার জন্য ফল সাজানো এ পাত্র কিনেন। এ ছাড়া গেটের দুপাশে আছে আদিবাসী রাখাইনদের তাঁতে বোনা সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি, শাল, ওড়না, গামছা, রুমালসহ বিভিন্ন তাঁতসামগ্রীর দোকান। আমরা মন্দিরে পূজা দেওয়ার নিমিত্তে পূজার সামগ্রী কিনে নিলাম।
আমরা এগিয়ে চলছি নগ্ন পায়ে। মিষ্টি হিমেল হাওয়া আমাদের যাত্রা পথের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল। একপাশে সবুজ ঘেরা বনাঞ্চল, অন্যপাশে সমতল ভূমি। চলতি পথে অপরিচ্ছনতা একটু খারাপ লাগলো বৈকি। অনেক সিঁড়ি বেয়ে আসার পর মন্দিরের গেটের দেখা পেলাম। এ গেটের বাম পাশ দিয়ে আরেকটি সিঁড়ি উঠে গেছে পাহাড়ের দিকে। আমরা পাহারের দিকে না গিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করি। মন্দিরের বাঁ পাশে দেখা পেলাম আদিনাথ মন্দিরের ঐতিহাসিক পটভূমি। অপর পাশে দেখতে পেলাম আগত দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য বসার ব্যবস্থা। আমরা এগিয়ে চলছি। চোখে পড়ল শত বছরের পুরোনো পাঁথরের দরজা, রাধাগোবিন্দ মন্দির, অষ্টভূজা মন্দিরের। আমরা এগিয়ে চললাম মূল মন্দির পানে। আমাদের মত অনেকেই এসেছেন আদিনাথ মন্দিরে। কেউ এসেছেন পূজা দিতে, কেউ এসেছেন ঐতিহাসিক স্থান দর্শনের নিমিত্তে।
প্রবেশ করলাম মূল মন্দিরে। পবিত্র মন্ত্রউচ্চারণের ধ্বনি আর ধূপকাঠির মহোনীয় সুবাস নিয়ে গেল অন্য ভুবনে। প্রতিদিনই নিয়ম মোতাবেক আদিনাথ, অষ্টাভূজা, ভৈরব ও রাধা গোবিন্দরে একই সময়ে পূজা-অর্চনা হয়ে থাকে। এছাড়া প্রতি বৎসর ফাল্গুনের শিব চতুর্দশী তিথিতে পূজা-অর্চনা ও পক্ষকালব্যাপী মেলা হয়। মন্দিরে বিরল প্রজাতির পারিজাত ফুলগাছ রয়েছে। ভক্তগণ প্রতিনিয়ত মনস্কামনা পূরণার্থে মানত করে গাছে সুতা বেঁধে রেখে যান এবং কামনা পূর্ণ হলে সুতা খুলে পূজা অর্পণ করেন।
মূল মন্দিরের পেছনের দিকে দুটি পুকুর রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ২৮০ ফুট উচ্চতায় পুকুর দুটির অবস্থান হলেও এর জল কখনই শুকায় না। জনশ্রুতি রয়েছে দুটি পুকুরের মধ্যে একটিতে স্নান করলে সকল রোগ দূর হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুর্যোগপ্রবণ থাকে এই অঞ্চল। তাই এই মাসগুলোকে উপেক্ষা করে সারা বছরই ঘুরতে যাওয়া যায় এই পাহাড়ি দ্বীপে। তবে এখানে ভ্রমণের সেরা সময় হচ্ছে শীতের শুরু এবং বসন্তের সময়। ঠান্ডা রোদ আর শিশির ভেজা বালুকাবেলার সঙ্গে পূর্ণিমা রাত ও ফানুস উৎসব ভ্রমণের আনন্দকে পূর্ণতা দিবে।
মহেশখালী যাওয়ার উপায়
মহেশখালীতে যাওয়ার চিরাচরিত এবং রোমাঞ্চপ্রিয়দের জন্য প্রিয় পথটি হচ্ছে কক্সবাজারের সমুদ্রপথ। এর জন্য সড়ক, রেল কিংবা আকাশপথে প্রথমে কক্সবাজার আসতে হবে। ঢাকার যাত্রাবাড়ি, মালিবাগ, কলাবাগান, ফকিরাপুল, মহাখালী অথবা গাবতলী থেকে পাওয়া যাবে কক্সবাজারের বাস। ২০২৩ এর ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস রেলপথ চালু হয়েছে। শোভন চেয়ারে জনপ্রতি ৬৯৫ টাকা আর স্নিগ্ধাতে জনপ্রতি ১ হাজার ৩২৫ টাকা ভাড়ায় পুরো যাত্রায় সময় লাগে ৯ ঘণ্টা। মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা সম্পন্ন করতে চাইলে আকাশপথে যেতে হবে। কক্সবাজার শহরে পৌঁছে এবার সরাসরি চলে যেতে হবে মহেশখালী যাবার জেটি বা ৬ নম্বর ঘাটে। এখান থেকে স্থানীয় ট্রলার বা স্পীড বোটে জনপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা ভাড়ায় মহেশখালী যাওয়া যাবে। সময় লাগতে পারে ২০ মিনিট। আর ট্রলারে সময় নেবে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট।
মহেশখালী যাওয়ার আরেকটি পথ হচ্ছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম দিয়ে সড়কপথে চকরিয়া হয়ে যাওয়া। এ পথে চকরিয়ার বদরখালি হয়ে মহেশখালীতে প্রবেশ করতে সময় লাগবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। যে জেটি থেকে মহেশখালীগামী নৌকা বা ট্রলারে উঠতে হবে সেটি চকরিয়া হয়ে যাওয়ার পথেই চোখে পড়বে।
মহেশখালী জেটিঘাট থেকে ব্যাটারচালিত টমটম বা ইজিবাইকে করে যেতে হবে মহেশখালীর প্রধান আকর্ষণ আদিনাথ মন্দির। চাইলে আপনি হেঁটেও যেতে পারেন। এখানে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি বৌদ্ধবিহার রয়েছে। বিখ্যাত আদিনাথ মন্দির আর বৌদ্ধবিহার ঘুরে দেখে আপনার মন প্রশান্তিতে ভরে যাবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রলার ও স্পীড বোট পাওয়া যায়। মন্দিরে তীর্থযাত্রীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া মহেশখালীতে মোটামুটি মানের থাকার হোটেল আছে। তবে একটু উন্নত পরিবেশে থাকতে চাইলে কক্সবাজার অথবা চকরিয়াতে থাকা যেতে পারে।