শিল্প ও সাহিত্য

তেভাগার লড়াই এবং কাঁটাতারে বিদ্ধ প্রজাপতি ইলামিত্র

‘বঙ্গদেশীয় কৃষক সামান্য ছিন্ন বস্ত্র পরিধান ও মোটা অন্ন আহার করে। তাহারা স্বল্প আয়ের গ্রাহক, এ কারণে তাহার সঞ্চয করা দূরে থাকুক, সে অধিক সুদে কর্জ লইয়া মহাজনের নিকট নিয়ত বদ্ধ রহিয়াছে। পরমেশ্বরের অনুগ্রহে বঙ্গদেশের ভূমিতে প্রচুর শস্য ফলাদি উৎপন্ন হয়। কিন্তু পরিতাপ, কৃষকের দুরবস্থা দেখিলে পাষাণতুল্য কঠিনান্তঃকরণও করুণায় আর্দ্র হইয়া যায়। তাহার মাসিক ব্যয় ১।। টাকা অথবা ৩ টাকার অধিক নহে। বার্ষিক ব্যয় একশত টাকার অধিক হয়, একশত কৃষকের মধ্যে এমত অবস্থান্বিত পাঁচ ব্যক্তিও প্রাপ্ত হওয়া যায় না। কৃষকের মধ্যে অত্যল্প ব্যক্তি, আপনার উপার্জ্জন দ্বারা পরিবার প্রতিপালন করতে পারে... অসিদ্ধান্ত ও সামান্য শাকাদি ভোজনেই সংতৃপ্ত থাকে, যে দিবসে মাংস পায় সে দিবসে আনন্দের সীমা থাকে না। কটিদেশে ছিন্ন বস্ত্র ও দর্ম্মাদুরি এবং তৃণের বালিশই তাহাদিগের কোমল শয্যা হইয়াছে, সম্পদের মধ্যে কাষ্ঠের হল ও লৌহ ফলাকা, এবং এক অথবা দুইটি বলদ...।’ মি. রবীন্স।। সংবাদ প্রভাকর।। ৫.৫.১২৬৪ বঙ্গাব্দ।।

শিল্পের বিকাশ না ঘটায় বাংলা-ভূখণ্ডে সঙ্গতকারণেই শিল্প-শ্রমিকের সংখ্যা চিরকালই নগণ্য। ভূমির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা একদিকে যেমন সৃষ্টি করেছে জমিদার শ্রেণিকে, তেমনই সৃষ্টি করেছে কৃষিশ্রমিক। বলা চলে বাংলাদেশে শ্রমিক-শোষণের চিত্র খুঁজতে হলে কল-কারখানার সাথে সাথে তাকাতে হবে সেই কৃষির দিকেই। প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিদাসপ্রথা বাংলাদেশে না থাকলেও কৃষিতে বয়ে চলেছে চিরন্তন সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্কের ধারাবাহিকতা। 

মনে রাখা দরকার, ভূমি শুধু বাংলাদেশের মানুষের সম্পদই নয়, বরং ভূমি তার পরিচয়চিহ্ন, তার সংস্কৃতির ধারক, তার অস্তিত্বের ঘোষক, তার শেকড়ের আশ্রয়। তাই বাংলাদেশের মানুষকে বুঝতে হলে তাকে বুঝতে হবে তার ভূমিকে পটভূমিকায় রেখে। বাংলাদেশের ইতিহাস তাই ভূমি-সম্পর্কিত মানুষের ইতিহাস। বাঙালিকে কেন্দ্র করে যে শিল্পসৃষ্টি, সেই সব শিল্পের কেন্দ্রেও যে মানুষ, সেই মানুষ মৃত্তিকালগ্ন, এবং কখনো কখনো মৃত্তিকাকেন্দ্রিক। সেইসঙ্গে জমিসংশ্লিষ্ট মানুষের মধ্যে শ্রমশোষণের কত রকম পন্থা ও প্রক্রিয়া ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত হয়ে আসছিল, সেই রেখাচিত্রও প্রাসঙ্গিক।

    ‘জমির উপর সাধারণ অধিকার, কৃষি ও হস্তশিল্প সংমিশ্রণ এবং এমন একটা অপরিবর্তনীয় শ্রম-বিভাগ যাহা কোনো নূতন গ্রাম-সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইবামাত্র একটা ছক কাটা নিয়ম হিসাবে ব্যবহৃত হইত। ইহাই ছিল গ্রাম-সমাজের ভিত্তি। সর্বাপেক্ষা সরল রূপের গ্রাম-সমাজে সকলে একত্রে মিলিয়া জমি চাষ করিত এবং সমাজের সকল সভ্যের মধ্যে ফসল ভাগ করা হইত। তাহার সঙ্গে প্রত্যেক পরিবারের সাহায্যকারী শিল্প হিসাবে সুতা কাটা ও কাপড় বুনিবার ব্যবস্থা ছিল।... রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝা সমাজের মূল অর্থনৈতিক উপাদানসমূহের কাঠামোটাকে স্পর্শই করিত না। কিন্তু ব্রিটিশরা আসিয়া এই অপরিবর্তনীয় সমাজ ব্যবস্থাকে চুরমার করিয়া দেয়।’- কার্ল মার্কস-এর এই মন্তব্যকে সর্বাংশে সত্য বলে মেনে না নিলেও এটুকু তো অন্তত জানাই যায় যে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার কৃষি ও কৃষককে আরো বেশি ও চিরস্থায়ী দুর্দশার মধ্যে নিপতিত করেছে। তার জের এদেশের কৃষক সমাজকে টেনে চলতে হচ্ছে এখন পর্যন্ত । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমি চলে যায় কৃষকের হাত থেকে সরকারের হাতে। সরকার নিজের রাজস্ব আদায়ের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সৃষ্টি করে বিপুল সংখ্যক মধ্যস্বত্তভোগী। সরকারের সৃষ্ট এই মধ্যস্বত্ত্বভোগীর প্রতিপালনের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার যে শুধু কৃষককে বহন করতে হতো তাই-ই নয়, বরং সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এই মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা নিজেরাও পরিণত হয়েছিল কৃষকের ওপর অত্যাচার পরিচালনাকারী প্রভুশ্রেণির অংশে। সরকার ও কৃষকের মাঝখানে ছিল জমিদার, জায়গীরদার, লাখেরাজদার, ঘাটওয়াল, ইজারাদার, দর-ইজারাদার বা টিক্কাদার, তালুকদার, পত্তনিদার, জঙ্গল-বুড়িদার, গাঁতিদার, জিম্মা-তালুকদার, আশাত তালুকদার, নিম-আশাত তালুকদার, হাওলাদার, আশাত হাওলাদার, নিম-আশাত হাওলাদার, নিম-হাওলাদার, আশাত নিম-হাওলাদার, মিরাশি কর্ষা, কায়েম কর্ষা, কর্ষাদার। সকল অঞ্চল এবং সকল জমিদারিতে হয়তো এই শোষক-পিরামিডের সকল স্তর সমানভাবে বিন্যস্ত ছিল না, তবে অধিকাংশই ছিল এবং ক্রমবর্ধিষ্ণুই ছিল।    

   কৃষকের নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভূত একটি শ্রেণি হচ্ছে বর্গাদার বা আধিয়ার। নিজের জোত-জমি বিক্রি করে নিঃস্ব কৃষক প্রকারান্তরে পরিণত হয় মহাজনের প্রজায়। মহাজন জমি চাষ করে না নিজে। বরং জমিকে সে মূলধন হিসেবে এমনভাবে ব্যবহার করে যাতে তা তাকে ক্রমবর্ধমান হারে মুনাফা প্রদান করতে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়া যে বাড়তির দিকে তার প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় জে. সি. জ্যাকের রিপোর্ট থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মহাজনদের হাতে জমি চলে যাওয়ার প্রবণতা বৃ্িদ্ধ পাচ্ছে। এসব জমি সেই সকল প্রজার কাছে মহাজনরা পুনরায় খুব ইচ্চহারে বন্দোবস্ত প্রদান করে যাদের নিকট থেকে তারা জমির ডিক্রি লাভ করেছিল। মহাজন ক্রেতা সাধারণত আদালত-ঘোষিত সেই ঋণীদেরকে পুনর্বন্দোবস্ত দান করে, যারা লিখিতভাবে না হলেও কার্যত রায়ত, যদিও তাদের দখলি রায়তের অইনগত অধিকার নেই।’ এই বক্তব্যের সাথে একইসাথে মন্তব্য করা হচ্ছে এই বলে যে- ‘নগদ খাজনা বা ফসলে খাজনা পদ্ধতিতে পুনরায় বন্দোবস্ত প্রদান করা জমির অত্যাচারপূর্ণ খাজনা আদায় প্রতিরোধের জন্য বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের ৪৮ ধারার দুর্বল বিধান যথেষ্ট নয়।’

    এই নতুন প্রজাপদ্ধতিতে আলাদা তিনটি ধরন ছিল ধান্যকড়ারী বা ধানকড়ারী, ঢাকী এবং বর্গা। ধীরে ধীরে প্রথমোক্ত দুটি প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং বাংলাদেশের কৃষকসমাজ পুরোপুরি বর্গাপ্রথার কবলিত হতে থাকে। ব্রিটিশ শাসন অবসানের সময়, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশের মোট কৃষকের শতকরা ৩০ ভাগ বর্গা-কৃষকে পরিণত হয়।

    অথচ এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য কোনো সরকারি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ১৯০০ সালের দশকের পূর্ব পর্যন্ত বর্গা সম্পর্কিত মামলাকে খাজনা সম্পর্কিত মামলার সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করা হতো। বর্গাদার তখন শ্রমিক হিসেবে বিবেচিত হতো না, বিবেচিত হতো প্রজা হিসাবে। কিন্তু ১৯০৯ সালে কলকাতা হাইকোর্টের এক রায়ে এই প্রতিষ্ঠিত রীতি খারিজ হয়ে যায়। রায়ে বলা হয় যে- ‘উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক বর্গাদার এবং অর্ধেক মলিক পাবে এমন চুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে ভূস্বামী ও প্রজার সম্পর্ক সৃষ্টি করে না।’ এই রায় মহাজন-ভূস্বামীদের হাতকে শক্তিশালী করেছিল। তারা রায়ের এই অর্থ নির্ধারণ করে যে, চাষকৃত জমির ওপর বর্গাদারের কোনো অধিকার নাই, তারা নিতান্তই শ্রমিক, এবং ফসলের যে অর্ধেক তারা পায়, তা তাদের পারিশ্রমিকমাত্র। ফলে বর্গাদাররা আরো অসহায় হয়ে পড়ে। বলা চলে তারা পরিণত হয়ে পড়ে মহাজনের হাতের ক্রীড়নক। কোনো অধিকার না থাকায় মহাজনের ইচ্ছাই পরিণত হয় আইনে। তাদের ওপর চাপানো হতে থাকে ইচ্ছামতো শর্ত। যেমন বর্গাদারকে চাষাবাদের যাবতীয় খরচ তার প্রাপ্য শতকরা ৫০ ভাগের মধ্য থেকেই করতে হতো। প্রায় সবক্ষেত্রেই হাল ও গরু ছিল বর্গাচাষীর। বীজের ব্যাপারে এলাকা ভেদে কিছুটা তারতম্য পরিলক্ষিত হতো। তবে এক পর্যায়ে দেখা গেল সার, বীজ, বালাইদমন- সবকিছুই এসে চেপে বসেছে বর্গাদার বা ভাগচাষীর কাঁধে।

    শোষণ যখন এত অমানবিক, বিদ্রোহ সেখানে খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের বর্গাদার বা ভাগচাষীরা বিভিন্ন সময় অন্দোলনে নেমেছেন। সেসব আন্দোলনের ইতিবৃত্ত সংকলিত হয়েছে মানবপ্রেমিক বিভিন্ন ইতিহাসবিদের গবেষণায়। তবে সর্বব্যাপী এবং সর্ব- সাম্প্রতিক আন্দোলনের নাম তেভাগা আন্দোলন। 

তেভাগা আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক নেতৃত্বের আসনে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। বাংলাদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন একটি মাইলফলক হয়ে আছে।      সেলিনা হোসেন তাঁর ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে তেভাগা আন্দোলনের একটি পর্যায়কে ধারণ করেছেন। এই উপন্যাস তেভাগা অন্দোলন নিয়ে, নাচোল অঞ্চলে তেভাগার অগ্রসৈনিক সাঁওতাল ভাগচাষী ও প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে, এবং কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্রকে নিয়ে।

০২. ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসের রচনাকাল ডিসেম্বর ’৮৫ থেকে জুন ’৮৮। অর্থাৎ এই উপন্যাসটি লিখে শেষ করতে ঔপন্যাসিকের সময় লেগেছে কিঞ্চিতাধিক আড়াই বৎসর। বাংলাদেশে ঈদসংখ্যাগুলিতে পনেরো দিনের মধ্যে উপন্যাস লেখার সংস্কৃতি প্রচলিত রয়েছে আমাদের লেখকদের মধ্যে। এদেশের অনেক লেখকের এক বছরে যতগুলি উপন্যাস প্রকাশিত হয়, বিশ্বের অনেক লেখকই সারাজীবনেও অতগুলি উপন্যাসের জনক হবার গৌরব অর্জন করতে পারেন না। এহেন বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক হয়েও সেলিনা হোসেন যখন একটি উপন্যাস রচনায় আড়াই বছর ব্যয় করেন, তখন বুঝতে হবে, সেই উপন্যাস রচনার কাজটিকে লেখক অত্যন্ত গুরুত্ব ও মনোযোগের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট উপন্যাসের সঙ্গে লেখকের একটি মহৎ উপন্যাস রচনার আকাঙ্ক্ষা যেমন জড়িত আছে, তেমনই জড়িয়ে আছে এর বিষয়বস্তু ও ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির প্রতি লেখকের ভালোবাসা এবং আবেগ। সেই সঙ্গে উপন্যাসে বিধৃত পটভূমি অর্থাৎ তেভাগা আন্দোলনের গৌরবময় আত্মদান ও বীরত্বের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করার দায়বদ্ধতা। 

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অবশ্যই ইলা মিত্র। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় ইলা সেন, ইলা মিত্র হয়ে আসছে কলকাতা ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি নাচোলে। সেই ইলা সেন যে ‘শ্যামলা, ছিপছিপে লম্বা, জ্যা-মুক্ত ধনুকের মতো বাঁকিয়ে ছেড়ে দিলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে।’ ১৯৩৬ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত খেলাধুলোয় তার নাম ছিল প্রথম সারিতে। অ্যাথলেটিক্স ছিল প্রিয় বিষয়। ভারতের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের অনেক রেবর্ড ভেঙেছে শীর্ণকায়া এই বাঙালি মেয়ে। মাঠের খেলা শেষ করে যে ভাবছে এবার তার জীবনের খেলা শুরু। তবে বৃহত্তর জীবনের ডাক সে আগেই শুনতে পেয়েছে। এবং সাড়াও দিয়েছে সেই ডাকে। ১৯৪৩ সালে যখন বি.এ. সম্মান ক্লাসের ছাত্রী, তখনই সে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্য। আবার একই বছর লাভ করেছে কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ।

সেই ইলা মিত্র নেহায়েত গৃহবধূ হয়ে আসছে না নাচোলে। আসছে মানুষের শোষণমুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতেও। স্বামী রমেন মিত্র শুধু নাচোলের জমিদার-তনয় নয়, নিজেও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। নাচোল অঞ্চলে গড়ে ওঠা কৃষক-ভাগচাষীদের আন্দোলনের প্রথম সারির সৈনিক। সেই আন্দোলনে আরো বাড়তি গতি সঞ্চার করা ইলা মিত্র ও তার স্বামী রমেন মিত্র- দুজনেরই লক্ষ্য।

নাচোল, শিবগঞ্জ অঞ্চলে আন্দোলনের জমি অনেকখনি তৈরি করে রেখেছে রমেন মিত্র, ফণী মাস্টার, আজিজ, মাতলা সর্দার, শুক্র মাডাং, হরেক, সতীশ সরকাররা। গ্রামে গ্রামে গঠিত হয়েছে কৃষক সমিতি, কমিউনিস্ট পার্টির শাখা সংগঠন। গ্রামের মানুষ জানে যে, বাঁচার মতো বাঁচার অধিকার আদায় করতে হলে আন্দোলন ছাড়া পথ নাই। তারা মোটামুটি এটাও জানে যে আন্দোলনের পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তাদের পেরুতে হবে অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার পথ। সেই জন্য তারা মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুতও বটে।

কলকাতা শহরের রাজনীতিতে অভ্যস্ত ইলা মিত্রের পক্ষে নাচোলের মতো নিঝুম পল্লীতে অচেনা অদেখা মানুষদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে কিছুটা অসুবিধা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অন্তরের প্রবল তাগিদের কাছে তুচ্ছ খড়-কুটোর মতো উড়ে যায় এইসব বাধা-বিপত্তি। প্রথম বাধা, পুরাতন সামন্ত-পারিবারিক ধ্যান-ধারণায় অভ্যস্ত শাশুড়ির বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তি। পায়ে হেঁটে জমিদার বাড়ির বউ কোথাও যেতে পারবে না। প্রথমে তা মেনে নিতে হয় ইলা মিত্রকে। মনে আশা, ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়ানো যাবে শাশুড়িকে। তাই সদ্য প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের স্কুল বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ হলেও শাশুড়িকে সন্তুষ্ট রাখতে গরুর গাড়িতেই যেতে হয়। রমেন মিত্রের বন্ধু আলতাফের উৎসাহে কৃষ্ণগোবিন্দপুরে মেয়েদের জন্য স্কুল খোলা হয়েছে। ইলা মিত্র তার অবৈতনিক প্রধান শিক্ষয়িত্রী। ছাত্রীদের কাছ থেকে কোনো বেতন তো নেওয়া হচ্ছেই না, বরং তাদের বই-খাতার বন্দোবস্তও করা হচ্ছে রমেন এবং ইলা মিত্রের উদ্যোগে। কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির কাজে নামার আগে এই স্কুল ইলা মিত্রের প্রাক-প্রস্তুতির অংশ। 

তিন মাসের মধ্যেই  স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা তিন থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় পঞ্চাশে। আর সেই সঙ্গে বাড়তি লাভ হিসাবে পাওয়া গেছে শাশুড়ির নিষেধাজ্ঞার শিথিলতা। গরুর গাড়ির বদলে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি জুটেছে ইলা মিত্রের। শুধু স্কুলে যাওয়ারই নয়, নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্য গ্রামের মানুষদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার অনুমতিও মিলেছে শাশুড়ির কাছ থেকে। সেই সঙ্গে বাধাও এসেছে কিছু। চিরন্তন পশ্চাৎপন্থী মানসিকতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মের নামে, শরিয়তের নামে, মেয়েদের পর্দাপ্রথার নামে বাধা এসে দঁড়িয়েছে পথ রোধ করে। সেই বাধার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে ইলা মিত্রকে। মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ইলা মিত্রের সচেতন প্রচারণা অভাবনীয় কাজ দিয়েছে। তার স্বরূপ দেখা যায় স্কুল প্রাঙ্গণে অয়োজিত উন্মুক্ত বিতর্কসভায়। সেখানে গরিব, ধর্মপ্রাণ কৃষক ওয়াজেদ মোড়লের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়Ñ ‘মেয়েরা স্কুলে গ্যালে শরিয়ত বেপর্দা হয় বুল্যা চেঁচাচ্ছে গাঁয়ের বড় মানুষরা। হামার কথা হলো, শরিয়ত-বিরোধী কাজ হয় কুন্টা? জোতদারের বাড়িত কাম করল্যে বেপর্দা হয় না? বাঁদীগিরি করল্যে বেপর্দা হয় না? বড় মানুষের বাড়ির ল্যাগা যে মেয়েরা মেলা দূর দূর থ্যাক্যা পানি অ্যানতাছে, কৈ এর লিগ্যাতো বেপর্দার কথা উঠে না? জোতদাররা যে ম্যায়া মানুষের ইজ্জত নষ্ট করে তা শরিয়ত-বিরোধী কাজ লয়? জোতদাররা হামারঘে চুষ্যা খায় বুল্যা চায় না হামরা কিছু জ্যানবার পারি!’

এই বিতর্কসভা থেকেই একসময় বক্তব্য ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। কৃষকরা নিজে নিজেই আবিষ্কার করে জোতদাররা যে স্কুলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তার পেছনে শুধু ধর্মান্ধতাই নেই, আছে শ্রেণিশত্রুতাও। সভায় উপস্থিত আরেক গরিব কৃষক কায়েস মন্ডলের বক্তব্যে পাওয়া যায় সেই শ্রেণীচেতনারই প্রতিধ্বনি। গুছিয়ে কথা বলতে জানে না কায়েস মন্ডল। জনসমক্ষে দশজনের সামনে বক্তা হয়ে কথা বলতে পারবে, এমনটি সে ভাবেওনি কোনোদিন। কিন্তু বলতে চাওয়া কথাগুলির চাপেই তার মুখ খুলে যায়। লেখকের ভাষায়— ‘কায়েস মন্ডলের গলায় তেমন জোর নেই, কথা বেধে যায় বারবার, তবু বলার চেষ্টা করছে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নেয়, একটু পর পর ‘ভাইসাব’ বলে শক্তি সঞ্চয় করে।’ তবু শেষ পর্যন্ত সে নিজের মনের কথাগুলি ঠিকই বলতে পারে—‘ হামরা জানি, শরিয়তে সুদ খাওয়া হারাম। কিন্তু হামারঘে চারপাশে য্যারা আছে, তারা সুদের টাকার পাহাড় ব্যানাচ্ছে। তাদের কি সুদ হালাল? জোতদাররা, মহাজনরা ঋণের টাকার সুদ খ্যায় ক্যান? হ্যাকের মুখে কি বড় কথা মানায়? ক্যাবল যত দোষ হামারঘে, হামরা গরীবরা হামারঘে গায়ের চ্যামড়া দিয়্যা সুদের ঢোল বানাই।’

এই বক্তব্যই নির্ধারণ করে দেয় আন্দোলন এখন কোন স্তরে পৌঁছেছে। কায়েস মন্ডল যখন বলে ‘জোতদারঘে মুখে লাথ্থি’ তখন তার এই কথার প্রতিধ্বনি উঠতে সময় লাগে না মোটেই।

উত্তরবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলে বেশ আগেই তেভাগার লড়াই শুরু হয়ে গেছে। রংপুরে শহীদ হয়েছেন তন্নারায়ণ। তেভাগা ছড়িয়ে পড়েছে দিনাজপুর, নীলফামারি, ঠাকরগাঁও, পঞ্চগড়ে। ইলা মিত্র, রমেন মিত্র, মাতলা সর্দার, হরেক, আজিজরাও নাচোলে শুরু করে তেভাগার লড়াই। স্লোগান ওঠে- ইনকিলাব জিন্দাবাদ। ধান কাটা শুরু হয়। সমিতির নির্দেশ আসে, কেউ আলাদা ভাবে নিজের চাষকৃত জমির ধান কাটবে না। সংঘবদ্ধ হয়ে অনেকগুলো ক্ষেতের ধান স্বল্প সময়ে কেটে শেষ করতে হবে। ধান জোতদারদের খোলানে যবে না, যাবে চাষীর বাড়িতে। সেখানে মেপে তেভাগার নিয়ম অনুসারে তিন ভাগের এক ভাগ তুলে দেওয়া হবে জোতদারের হাতে।

প্রথম তেভাগা কায়েমের ধানকাটার বর্ণনা উপন্যাসে এসেছে গভীর আবেগের সঙ্গী হয়ে—‘আজ উৎসব’। মহা-সমারোহে ফসল কাটা শুরু হয়েছে। এই উৎসবের কোনো সাম্প্রদায়িক ভিত্তি নেই। হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতাল সবই এসেছে। এই উৎসবের হৃদয় ফসল, শরীর অধিকারের প্রতিষ্ঠা। সবাই ব্যস্ত। লালপেড়ে শাদা শাড়ি পরেছে ইলা। কপালে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুরের ফোঁটা। যখন সে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি যায়, কখনো ধূলি-ধূসরিত খালি পায়ে, তেলহীন রুক্ষ চুল বাতাসে ওড়ে, তখন কোমরে প্যাঁচানো থাকে শাড়ি। যখন ওদেরকে আন্দোলনের কথা বোঝায়, তখন উদ্দীপিত থাকে দৃষ্টি, কঠিন হয়ে ওঠে চোয়াল। এখন কিছুটা ক্লান্ত, কিছুটা উদ্বিগ্ন। ইলা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ধান-কাটার কাজ নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাচ্ছে। মাতলা খুশিতে গদোগদো। অন্যান্য জোতদার বাধা দিতে আসেনি। ওরা নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। রমেন মিত্র মাতলাকে জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগছে মাতলা?

    ও খুশিতে মাথা দোলায়। তারপর ছুটে যায় ইলার কাছে।     রানী মা?     আজ আমাদের পরব না রে মাতলা?     মাতলা খুশি হয়ে প্রণাম করে। রানীমা ওদের জন্য কাজ করছে। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সবার ঘরে ঘরে গিয়েছে। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া হয়নি, শরীর পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে, তবু নিজের দিকে তাকায়নি। আজ তো পরবের দিন হবেই।’

    অবশ্যম্ভাবীরূপে এর পরে আসে সরকারি দমন-নীতির কথা। রাষ্ট্র এগিয়ে আসে তার সমুদয় নখ-দন্ত বিস্তার করে। উৎকটভাবে প্রকাশ করে তার শ্রেণীশাসনের স্বরূপ। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসম শক্তি নিয়েও তার লড়াই চালিয়ে যায় ইলা মিত্র। তাকে বুক দিয়ে আগলে রাখে সাঁওতাল নারী-পুরুষ, ক্ষেতমজুর, প্রান্তিক চাষী, শোষিত মানুষের দল। 

কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। সাঁওতাল সঙ্গী ও সহযোদ্ধাদের নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ইলা মিত্র। তারপরের ইতিহাস বর্ণনা করা বর্বরের পক্ষেও কষ্টকর। একজন নারীর ওপর যত রকম অত্যাচার করা সম্ভব, সব করেছে তৎকালীন ইসলামি রাষ্ট্রের পুলিশ ও পরিচালকরা। কিন্তু পরাজিত হয়নি ইলা মিত্র। লেখকের ভাষায়— ‘ইলা পাথরের মতো অনড়, নির্যাতনে ওর মুখে শব্দ নেই, যন্ত্রণায় ওর চোখে জল নেই। ও মহাকালের আকাশের নিচে কালো পাথরের মূর্তি, যার শরীরের ওপর দিয়ে শতাব্দীর ঝড় বয়ে যায়।’

    তার শরীরে পড়েছে অজস্র বুটের লাথি, লাঠি ও ব্যাটনের আগাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে তার শরীর, শরীর থেকে সমস্ত বস্ত্র টেনে খুলে তাকে নগ্ন করে চাবুক মারা হয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা। পাকিস্তানি ইঞ্জেকশন নামের মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানানো অত্যাচার হার মেনেছে ইলা মিত্রের চারিত্রিক দৃঢ়তার কাছে। ‘দু’জন সেপাই এসে ওর দু’বাহু ধরে ঘরের মেঝেতে চিৎ করে শুইয়ে দেয়। ওর দু’পায়ের ওপরে-নিচে দুটো লাঠি রেখে ওর পায়ে চাপ দিতে থাকে। রুমাল দিয়ে শক্ত করে ওর মুখ বেঁধে দেয়া হয়। যাতে কোনো আর্তনাদ ছড়িয়ে না পড়ে। প্রবল যন্ত্রণায় ওর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ও হাত বাড়িয়ে কিছু ধরতে চায়, না পেয়ে নিজের চুল ধরে। ও অনেক মানুষের কণ্ঠ শুনতে পায়, এই পাকিস্তানি ইনজেকশনেই মুখ খুলবে।’  কিন্তু মুখ খোলানো যায়নি ইলা মিত্রকে।

    তারপর পালাক্রমে গণধর্ষণ। এমনকি যৌনাঙ্গে সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দেওয়া। কিন্তু পরাজিত হয়নি ইলা মিত্র। বরং আদালতে নিজের জবানবন্দির সঙ্গে যখন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছে তার ওপরে বর্বর নির্যাতনের কথা, তখন নাচোলের ইলা মিত্র আর নাচোলে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং সারা দেশের বিবেকবান মানুষের কাছে ইলা মিত্র পরিণত হয়েছে মাতৃপ্রতীকে।

    শুধু ইলা মিত্র নয়, তার সহযোদ্ধা সাঁওতারদের ওপরেও চলেছে অকথ্য নির্যাতন। উদ্দেশ্য তাদের দিয়ে একথা বলিয়ে নেওয়া যে তাদের বিদ্রোহের উস্কানি দিয়েছে ইলা মিত্র। চার অত্যাচারি পুলিশ জনরোষের কবলে পড়ে নিহত হয়েছিল। সাঁওতালরা বলুক যে ঐ চার পুলিশক হত্যার আদেশ দিয়েছিল ইলা মিত্র। এটুকু বললেই তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু সেকথা বলতে রাজি হয়নি একজন সাঁওতালও। ঝড়ু কোচ আর বিজু মাঝিকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলেছে পুলিশ, কিন্তু তাদের মুখ থেকে এমন একটি শব্দও বের করতে পারেনি যা দিয়ে ইলা মিত্রকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। উপন্যাসে সাঁওতালদের সেই অনমনীয়তার কথা উঠে এসেছে— ‘ওরা একদৃষ্টে উদ্যত চাবুকের দিকে তাকিয়ে থাকে, বুক ফেটে যায়, শব্দহীন চোখের মণিতে ফুটে ওঠে ভাষা, আমরা মৌনব্রত অবলম্বন করেছি। এই কণ্ঠ দিয়ে কোনোদিন কোনো বর্ণমালা নির্ঝরিত হয়েছিলো কি না, আমরা জানি না। আমরা ভুলে গেছি পূর্বপুরুষদের ভাষা। আমরা পারি এখন গরুর মতো তাকিয়ে থাকতে। বুঝতে পারছি না ওরা কি বলছে। আমাদের বোধশক্তি স্তব্ধ, আমাদের কর্ণ বধির, আমাদের জিহ্বা কর্তিত। দোহাই লাগে, তোমরা আমাদের কোনো কিছু উচ্চারণ করতে বলো না। আমরা ভুলে যেত চাই পূর্বপুরুষের ভাষা। প্রভু জিঁয়ো আমাদের শক্তি দাও, শক্তি দাও!’

০৩. মানবজীবন ও সভ্যতাকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সামাজিক শ্রম। সামাজিক শ্রমের মধ্য দিয়েই বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের সক্রিয়তাগুলি পরস্পর সংযুক্ত হয়ে একটি সংগঠিত অবয়ব অর্জন করে। তার ফলে আসলে মানবসমাজ নিজেই নিজেকে বস্তুগতভাবে পুনরুৎপাদিত করে। মানবিক চেতনা ও মানবিক শ্রম সবসময়ই পরস্পর সংলগ্ন থাকে। এই সংলগ্নতার কারণেই বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের সংযোগ-প্রক্রিয়া অনিবার্য হয়ে ওঠে। সংযোগ-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য তখন খোঁজা হয় মাধ্যম। শিল্প সেই মাধ্যম। সেই শিল্পের অন্যতম প্রধান রূপ হচ্ছে উপন্যাস। বলা চলে, একটি সময়ের পূর্ণাঙ্গ সামাজিক বিন্যাস ও দ্বন্দ্বকে সবচেয়ে সার্থকভাবে ধারণ করতে পারে যে শিল্পমাধ্যম, তার নাম উপন্যাস। বালজাক, তলস্তয় এবং টমাস মান-এর উপন্যাসগুলি এই যুক্তিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে। সেলিনা হোসেন তাঁর এই উপন্যাসে সেই চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছেন। এই কারণ ছাড়াও আরো একটি কারণে তিনি উল্লেখযোগ্য। পোস্টমডার্ন সুবিধাবাদী তাত্ত্বিকদের লাগামহীন এবং অবিরাম প্রচারণায় শিল্পজগতে ‘দায়বদ্ধ’ শব্দটি যখন ভর্ৎসনার নামান্তর হয়ে উঠেছে, শ্রেণীচেতনার প্রকাশ নিন্দনীয় হয়ে উঠেছে, এমনকী প্রগতিশীলতার সাথে সংশ্লিষ্টতার অপরাধে যখন ‘একঘরে’ হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, ঠিক সেই সময় তিনি এমন একটি উপন্যাস রচনা করেছেন যাতে দায়বদ্ধতা রয়েছে, শ্রেণিচেতনার অভ্রান্ততায় আস্থাজ্ঞাপন রয়েছে এবং প্রগতিশীলতার সুস্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে। ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ আমাদের তরুণ লেখকদের অনেক বিভ্রান্তি ঘোঁচাতে সাহায্য করবে।

    নিজের সৃষ্টি কালের গণ্ডি পেরিয়ে মহাকালের সঙ্গে সংযুক্ত হোক অর্থাৎ ধ্রুপদী সৃষ্টির মর্যাদা লাভ করুক, সেই স্বপ্ন দেখেন প্রত্যেক লেখক। যদিও ঠিক কোন কোন গুণ বিদ্যমান থাকলে, বা কোন কোন শর্ত পূরণ করলে কোনো সৃষ্ঠি ক্লাসিকত্ব লাভ করতে পারে, তা অদ্যাবধি নির্ধারণ করতে পারেননি কোনো সাহিত্যতাত্ত্বিক। তবে সৎ সাহিত্য বলতে ঠিক কোন রচনাকে আমরা চিহ্নিত করব, তার মানদণ্ড ইতোমধ্যে নির্ধারিত হয়েছে প্রায় সর্বসম্মতভাবে। সৎ সাহিত্য মানুষকে জানায় তার অন্তহীন সম্ভাবনার কথা, তার কাছে পৌঁছে দেয় বৃহৎ জীবনের বার্তা। দিনানুদিনের গ্লানি, দুর্দশা ও প্রবলের উৎপীড়ণ যে চিরস্থায়ী নয়, উদার আনন্দময় পৃথিবী সৃষ্টি করা যে মানুষের পক্ষে অসম্ভব নয়, এই সুসমাচার পাওয়া যায় সৎ সাহিত্যে। ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ একটি সৎ সাহিত্য।