ক্যাম্পাস

জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যতের পথে তরুণদের প্রস্তুতির গল্প

জলবায়ু পরিবর্তন এখন ভবিষ্যতের কোনো আশঙ্কা নয়, বরং বর্তমান বাস্তবতার এক কঠিন সত্য। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘনঘন ঘূর্ণিঝড়, অনিয়মিত বৃষ্টি, খরা, নদীভাঙন সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান।

এই সঙ্কটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে তরুণ প্রজন্ম। ভবিষ্যৎ কারিগর তরুণরাই যদি সচেতন, দক্ষ ও সংগঠিত হয়, তবে জলবায়ু সহনশীল একটি সমাজ গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। এই ভাবনাকেই সামনে রেখে তরুনদের ক্লাইমেট রিসাইলেন্স এজেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে ‘প্র্যাকটিকাল একশন ইন বাংলাদেশ’ বিভিন্ন বিভাগে ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করছে দুই দিন ব্যাপী ‘ইয়থ ইন ক্লাইমেট রিসায়লেন্স ট্রেনিং’। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাছাই শেষে এই ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ আমার জন্য একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশে জলবায়ু অভিযোজন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, টেকসই জীবিকায়ন ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে ‘প্রাকটিকাল একশন’। মাঠ পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি কাজের পাশাপাশি তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তোলাকেও তারা গুরুত্ব দেয়।

সেই লক্ষ্যেই ১ ও ২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় এই আবাসিক প্রশিক্ষণ কর্মশালা। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তরুণদের এক ছাদের নিচে এনে জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ প্রস্তুতি, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা ও জলবায়ু সহনশীল কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়াই ছিল এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।

প্রথম দিনের সকাল শুরু হয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও তরুণদের ভূমিকা নিয়ে জলবায়ু নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা এক তরুণের অভিজ্ঞতা দিয়ে। বৈজ্ঞানিক তথ্যের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বোঝানো হয়, কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের কৃষি, জীবিকা, খাদ্যনিরাপত্তা ও দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করছে। এরপর দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও অ্যান্টিসিপেটরি অ্যাকশনের ধারণা নিয়ে বিস্তারিত সেশন হয়; যেখানে দুর্যোগের আগে কীভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়, তার বাস্তব উদাহরণ ও কৌশল শেখানো হয়। 

দুপুরের পর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার উপর প্রভাব এবং ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচারের ধারণা তুলে ধরা হয়; যা ভবিষ্যতের টেকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয় গ্রুপ ওয়ার্কের মাধ্যমে জলবায়ু ঝুঁকি, ভালনারেবিলিটি ও ইমপ্যাক্ট বিশ্লেষণের কাজ করা হয়; যেখানে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের এলাকার বাস্তব সমস্যাগুলো তুলে ধরে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। তাছাড়া, 'ডিজাস্টার এলার্ট ফর বিডি' অ্যাপের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দুর্যোগের আগাম তথ্য পাওয়া, নিরাপদ আশ্রয় পরিকল্পনা ও জরুরি সাড়া প্রদানের বাস্তব অনুশীলন করা হয়। 

দুপুরের পরে কমিউনিটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির সেশনটি ছিল সবচেয়ে কার্যকরী অংশগুলোর একটি। এখানে তরুণদের শেখানো হয় কীভাবে স্থানীয় পর্যায়ে আগাম সতর্কতা, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও সচেতনতা কার্যক্রম একসাথে পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যায়। সার্টিফিকেট প্রদান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে দুই দিনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটে।

তবে, এই প্রশিক্ষণ শুধু ক্লাসরুম ভিত্তিক শেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সারা দিনের টানা সেশন শেষে সন্ধ্যার সময় সমুদ্র সৈকতে ঘুরাঘুরি, আড্ডা, গল্প আর হাসি-আনন্দে ভরে উঠত পুরো পরিবেশ। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সমবয়সী তরুণদের সঙ্গে পরিচয়, তাদের কাজের গল্প শোনা, অভিজ্ঞতা বিনিময় সব মিলিয়ে এক নতুন কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুভূতি ছিল সত্যিই অসাধারণ। বাংলাদেশে বসেই আমার মতো অনেক তরুণ-তরুণী যে কত গভীরভাবে ও একনিষ্ঠভাবে জলবায়ু খাতে কাজ করছে, সেটা এই দুই দিন না দেখলে হয়তো কখনোই এতটা উপলব্ধি করা যেত না।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই কোনো একক মানুষের কাজ নয়; এটি একটি সম্মিলিত যাত্রা, যেখানে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণই পারে একটি সহনশীল, নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে। এই দুই দিন আমাদেরকে নতুন করে অনুপ্রাণিত করেছে জলবায়ু নিয়ে আরো গভীরভাবে কাজ করার জন্য, নিজের এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এবং বাস্তবসম্মত সমাধান তৈরির জন্য।