মেধাবী ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করা এবং তাদের মেধার সঠিক বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে সম্প্রতি ময়মনসিংহের সদর উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘মেধা অন্বেষণ’ নামে মেধাবৃত্তি পরীক্ষা। পুরো উপজেলার সকল বিদ্যালয়ের সেরাদের সেরা হওয়ার এই প্রতিযোগিতা দারুণ ভাবে উপভোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার সাবেক নির্বাহী অফিসার আরিফুল ইসলাম প্রিন্স এই প্রতিযোগিতাটির আয়োজন করেন। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী মূল্যায়নে আরিফুল ইসলাম প্রিন্সের অনন্য এ উদ্যোগটি নজড় কেড়েছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি ও জেলা প্রশাসনের।
তারা বলছেন, 'মেধা অন্বেষণ' নামের এই প্রতিযোগিতায় প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নের অনেক ক্ষেত্র ও সুযোগ রয়েছে। এই প্রতিযোগিতাটির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ১৮৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পাঁচটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির মোট ১৫৬৮জন শিক্ষার্থী এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। উপজেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোকে মোট ১০টি ক্লাস্টারে ভাগ করে ১০টি ভ্যেনুতে একযোগে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। বাংলা, ইংরেজি ও গণিত এই তিন বিষয়ে একশো করে, প্রাথমিক বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় মিলিয়ে ১০০। মোট ৪০০ নাম্বারের এই লিখিত পরীক্ষা গ্রহণে ৪ রঙের চারটি খাতা ব্যবহার করা হয়। বিষয় ভিত্তিক ১০০ নাম্বারের পাশাপাশি প্রতিটি পরীক্ষা শেষে ১৫ নাম্বারের মানসিক দক্ষতা ও সাধারণ জ্ঞান কুইজ টেস্ট গ্রহণ করা হয়।
এই পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে উপজেলার মাস্টার ট্রেইনার তালিকাভুক্ত বিষয় ভিত্তিক ১৬জন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা ৩দিনে পরিষদ হলরুমে বসে খাতা মূল্যায়ন করে।
পরীক্ষার সুষ্ঠ পরিবেশ নিশ্চিত করা ও পুরো প্রতিযোগিতাটি বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি ও শিক্ষা) কে উপদেষ্টা করে সমন্বয় ও বাস্তবায়ন কমিটি, উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তাকে আহবায়ক করে প্রশ্নপত্র ও মানবন্টন উপ- কমিটি এবং সহকারী কমিশনার ভূমিকে আহবায়ক করে বাজেট বাস্তবায়ন ও পুরস্কার ক্রয় উপ-কমিটি গঠন করা হয়।
প্রতিযোগিতায় উপজেলা পর্যায়ে প্রথম থেকে দশম স্থান অধিকারীদের সম্মাননা ক্রেস্ট এবং এককালীন শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। এছাড়া, প্রতিটি ক্লাসটার পর্যায়ে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকারীদের বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বিজয়ী হয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত। গর্বিত তাদের বাবা- মা ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
‘মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ২০২৫’ এ তৃতীয় স্থান অধিকারি তপস্যা সাহা বলেন, “প্রথম বার আমরা স্কুলের বাইরে গিয়ে এমন একটা পরীক্ষা দেয়। কিছুটা ভয় হয়েছিলো। সবসময় ক্লাসের পরীক্ষায় সেরা হওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখানে উপজেলার সকল স্কুলের সেরা শিক্ষার্থীরাও অংশ গ্রহণ করেছে। ফলাফল ঘোষণার সময় যখন প্লেস পেয়েছি। এটা শুনেই খুব ভালো লাগলো। খুব খুশি হয়েছি।”
এ সময় তপস্যা সাহার মা পুরবী সরকার বলেন, “এই পরীক্ষায় যে প্রশ্নপত্রের মান খুবই ভালো ছিল। খুবই কঠিন ছিল। বলতে গেলে, সত্যিই পরীক্ষায় মেধার অন্বেষণ ছিল। ফলাফলে যখন বলা হলো বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে একজন সেরা দশে আছে। তখনও বিশ্বাস হয়নি আমার মেয়ে। কিন্তু, ফলাফল ঘোষণা হয়, আমার মেয়ে পুরো উপজেলায় তৃতীয় হয়েছে। সত্যি ঐ মুহুর্তটা অনেক আনন্দের ছিল।'
‘মেধা অন্বেষণ’ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ছাত্র তাসনিমুল হক। তাসনিমুল বলেন, “এই পরীক্ষার মাধ্যমে একটু বড় পরিসরে নিজেকে যাচাই করার সুযোগ পেয়েছি। এতে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস কাজ করছে। এই ফলাফলটা জীবনের স্মৃতিতে থেকে যাবে। এই ধরনের প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকলে পরবর্তীতে যারা আসবে তাদের মধ্যে একটা বড় ধরনের প্রস্তুতি তৈরি হবে।”
ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালম বলেন, “এই ‘মেধা অন্বেষণ’ প্রতিযোগিতায় সেরা দশে আমাদের স্কুলের ৮জন রয়েছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের। আসলে আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতাটা মূলত নিজেদের ক্লাসেই মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই ধরনের আয়োজনে প্রতিটি ছাত্র নিজেকে বড় পরিসরে মেলে ধরতে পারে। মেধার উপযুক্ত মূল্যায়ন হয়ে থাকে।”
এই ‘মেধা অন্বেষণ’ প্রতিযোগিতার উদ্ভাবক সদর উপজেলার সাবেক নির্বাহী অফিসার আরিফুল ইসলাম প্রিন্স বলেন, “শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভালো কিছু করার চিন্তা থেকেই এই প্ল্যানটা আসে। উদ্যোগ গ্রহণের পর ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সকলে দারুণ সহযোগিতা করেছেন। শিক্ষার্থীরা বেশ উৎসাহী ছিলো। আগামী দিনেও এই ধরনের প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকলে শিক্ষার্থীদের ভালো হবে বলে মনে করি।”
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মো: সাইফুর রহমান বলেন, “আমি ময়মনসিংহে যোগদানের পর পরই সদর উপজেলায় ‘মেধা অন্বেষণ’ প্রতিযোগিতাটি দেখতে পাই। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। আগামী দিনেও এটি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করবো।”
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) এর মহাপরিচালক ফরিদ আহমদ জানান, “সদর উপজেলার সাবেক নির্বাহী অফিসার আরিফুর ইসলাম প্রিন্সের এই মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতাটি বেশ সাড়া পড়ে ছিল। আসলে আমরা এই ধরনের প্রতিযোগিতা কে সবসময়ই উৎসাহিত করি। আমাদের দেশে বিভিন্ন উপজেলায় বিচ্ছিন্ন ভাবে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যারা এই ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তাদের আমি প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখি। এই ধরনের প্রতিযোগিতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ুক এটা আমরা চাই।”
ফরিদ আহমদ আরো বলেন, “আমি সবসময় মনে করি, কোয়ালিটি এডুকেশনের জন্য ইভালুয়েশন একটি খুবই বড় প্যারামিটার। ইভালুয়েশনটা সব সময় পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক হওয়া উচিত। ছাত্র টু ছাত্র, বিদ্যালয় টু বিদ্যালয় এমনকি অভিভাবক টু অভিভাবক প্রতিযোগিতা করা ভাল। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়। মেধা অন্বেষণ এমনি একটি প্রতিযোগিতা।”