সারা বাংলা

বরগুনায় ভাঙনের মুখে ২ কিলোমিটার বাঁধ

‍বরগুনার পায়রা ও বিষখালী নদীর অব্যাহত ভাঙনে জেলার দুই কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বিলীন হওয়ার পথে। অসময়ের এই ভাঙনে আতঙ্কে দিন কাটছে নদীপারের হাজারো মানুষের। ভাঙনে ফসলি জমি, ঘর ও ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন তারা। এলাকাবাসী ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া ও ভাঙনের হুমকিতে থাকা স্থানগুলো হলো- বরগুনা সদর উপজেলার ছোট বালিয়াতলী, লতাকাটা, ডালভাঙা, পালের বালিয়া তলী, বামনা উপজেলার রামনা, বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ি, পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া ও কালমেঘা, তালতলী উপজেলার নলবুনিয়া, জয়ালভাঙা ও নিশানবাড়িয়া। 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতিবছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় বাঁধ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়। এ বছর অসময়ে বাঁধে ভাঙন চলছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারাতে হবে। টেকসই বাঁধের অভাবে উপকূলে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড বরগুনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.আবদুল হান্নান প্রধান জানান, ৪১/১এ, বি ও ৪১/৭ পোল্ডারের বাঁধ পুনর্বাসন, বেতাগী শহর, বিষখালী ও পায়রা নদী ভাঙন প্রতিরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আরএডিপি প্রকল্পের অর্থায়নে ৮২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৬ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার স্থায়ী টেকসই বাঁধ এবং একই প্রকল্পের আওতায় আরএডিপি প্রকল্পের অর্থায়নের ৭১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪ দশমিক ১৬০ কিলোমিটার টেকসই (ব্লক দিয়ে নির্মাণ) বাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে। আগামী দেড় বছরের মধ্যে এই কাজ শেষ হবে। 

তিনি বলেন, “বরগুনা জেলার ২২টি পোল্ডারে ৮০৫ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে জেলার ২ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভাঙনের মুখে। জায়গাগুলোতে স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক কাজ করতে হবে। ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে। একটি প্রকল্প পরিকল্পনাধীন। আমরা অর্থায়ন পেলে আশা করছি, ওই জায়গাগুলোতে স্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়ন করা হবে।” 

ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ

 সরেজমিনে দেখা গেছে, বরগুনা সদর উপজেলার এম বালিয়া তলী ইউনিয়নের পালের বালিয়া তলী, লতাটাকা, ডালভাঙা, বামনার উপজেলার দক্ষিণ রামনা এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের এক তৃতীয়াংশ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যে কোনো সময় বাঁধটি পুরোপুরি নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা স্থানীয়দের।

বরগুনা সদর উপজেলা এম বালিয়া তলী ইউনিয়নের পালের বালিয়াতলী গ্রামের বাসিন্দা রাবেয়া বেগম বলেন, “রাক্ষুসী পায়রা প্রতিবছর আমাদের ভিটা মাটি, ফসলি জমি গিলে খাচ্ছে। আমাদের এই স্থানে বাঁধ নেই দেড় যুগ ধরে। প্রতিবিছরই নতুন করে বাড়ি ঘর তোলতে (নির্মাণ) হয়। বাঁধ না দিলে আমাদের এখানে থাকার কোনো পোথ (পথ) নাই। এবার ভাঙলে আমাদের মাথা গোজার কোনো ঠাই থাকবে না। তখন পথে নামতে হবে। যাদের টাকা আছে তারা অন্য জায়গায় জমি কিনে বাড়ি করবে, আর আমাদের নদীতে ভাসতে হবে। পায়রা আমাদের শেষ করে দিয়েছে।”

পালের বালিয়াতলী এলাকার বাসিন্দা আবু সালেহ বলেন, “পায়রা নদীর অসময় ভাঙনের গিলে খাচ্ছে আমাদের বাড়ি। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রায় ৬০টি পরিবার ভাঙনের ঝুঁকিতে রেখে ৫০০ ফুট কম দূরত্বের স্থান থেকে একটি রিং বাঁধ নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বন্যার সময় দিন রাতে পানিতে তলিয়ে থাকি। আমাদের এই স্থানে যদি বালুর বস্তা ফেলা হয়, তা হলে আমরা ভাঙন থেকে রক্ষা পাব।” 

বামনা উপজেলা রামনা এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের জিও ব্যাগ ধসে বিষখালী নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এই স্থান দিয়ে বাঁধটি যে কোনো মূহূর্তে ভেঙে বিলীন হতে পাবে। 

ভাঙন এলাকার বাসিন্দা রিপন বলেন, “গতবছর এই এখানে বালুভর্তি বস্তা ফেলা হয়েছিল, কিন্তু তা ছয় মাসও টেকেনি। বিষখালীর উত্তাল ঢেউয়ের ছোবলে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে বাঁধের যে অংশটুকু টিকে আছে তা যে কোনো সময় বিলীন হতে পারে।”  

তালতলী উপজেলার জয়ালভাঙা এলাকার বাসিন্দা বাচ্চু মিয়া বলেন, “সিডরের আঘাতে পায়রা নদীতে বিলীন হওয়া বাঁধ আর পুননির্মাণ করা হয়নি। রিং বাঁধ নির্মাণ করা হলেও তা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। জোয়ারের পানিতে বাড়ি ও ফসল তলিয়ে যায়। গত কয়েক বছর ধরে ফসল চাষ করতে পারিনি।” 

জেলা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, “ঝড় বা অম্যাবসা-পূর্ণিমার জোয়ারে উপকূলের নদ-নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ার হলে পানির উচ্চতা ১৫ থেকে ১৮ ফুট বৃদ্ধি পায়। ষাটের দশকে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে বাঁধের উচ্চতা কম থাকায় উচ্চ জোয়ারে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। উপকূলের বাসিন্দাদের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য বাঁধ মেরামতের পাশাপাশি উচ্চতাও বাড়ানো দরকার।”     পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরগুনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.আবদুল হান্নান প্রধান বলেন, “বরগুনায় ব্যাপক আকারে নদী ভাঙন চলছে। আমরা কিছু স্থানে ইতোমধ্যে স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক কাজ করেছি। কিছু জায়গায় নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে। আমরা সাময়িকভাবে ভাঙন কবলিত স্থানগুলো রক্ষা করতে পারলেও ওই জায়গাগুলোতে স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক কাজ করতে হবে।” 

তিনি বলেন, “এসব এলাকায় ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে। একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। আমরা অর্থায়ন পেলে আশা করছি, ওই জায়গাগুলোতে স্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়ন করা হবে।”