ক্যাম্পাস

জলাভূমি থেকে সবুজ প্রাঙ্গণ পাবিপ্রবি: বৃক্ষরোপণ অভিযানের নান্দনিক গল্প

মাত্র ১৭ বছরের তরুণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়। জম্মলগ্নের জায়গা ছিল বিস্তীর্ণ জলাভূমি ও খোলা প্রান্তর। সময়ের সাথে সাথে সেই ভূমিতে গড়ে উঠেছে আকাশ ছোঁয়া নান্দনিক ভবন। তবে ক্যাম্পাসে যেন প্রাণ নেই, রুক্ষ পরিবেশ। নেই ফুল, নেই গাছ, নেই ছায়া। সেই চিন্তা থেকে ক্যাম্পাসকে আরো সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য বিশেষ বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাকৃতিক চরিত্র’ ফুটিয়ে তোলার জন্য গত মে মাস ২০২৫ থেকে নান্দনিক পরিকল্পনায় ফলজ, বনজ, ঔষধী ও শোভাবর্ধক ২৫০ প্রজাতির ১২০০ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। দেশের পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ, জীব বৈচিত্র্য, দূর্লভ গাছের সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনকে মাথায় রেখে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যুক্ত হয়েছে প্রশান্তির নতুন সুর। আগামী ৩ বছরের মধ্যে গড়ে উঠবে সবুজ ক্যাম্পাস। এ চিত্র উত্তরের প্রাচীণ জনপদ পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের।

নগর ও অঞ্চল বিভাগ, স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষকসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ছয় সদস্য বিশিষ্ট বৃক্ষরোপণ কমিটি গঠন করা হয়। পুরো বিষয় তত্ত্বাবধান করছেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বায়ো-বেজড কম্পোজিটস, কাঠ সংরক্ষণ, বায়ো-আঠা এং উদ্ভিদ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন।

বৃক্ষরোপণ কমিটি ৩০ একর ক্যাম্পাসকে ১২’শ জোনে ভাগ করে গাছের চারা রোপণ করার উদ্যোগ নেন। ৮ ঘনফুট বালি তুলে ফেলে সেখানে গোবর, দোঁআশ মাটি দিয়ে চারা লাগানোর ১ মাস আগে থেকে জায়গা প্রস্তুত করা হয়। একমাস ধরে জায়গাটি বিশেষভাবে প্রস্তুত করে উপযোগী করে তবেই গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। যেটি এখনো চলমান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “ক্যাম্পাসে বৃক্ষরোপণের প্রধানতম উদ্দেশ্য সবুজায়ন, সৌন্দর্যবর্ধন ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা। নাটোরের লালপুরসহ পাবনা উঞ্চ এলাকা হিসেবে ইতোমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে। শুস্ক মৌসুমে প্রচন্ড গরম পড়ে। পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ তাপমাত্রা কমাতে পারে। জীব বৈচিত্র্য মাথায় রেখেছি। দুর্লভ গাছ সংরক্ষণের বিষয়টি পরিকল্পনায় আছে। যে সব গাছ হারিয়ে যাচ্ছে সেসব গাছের সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করাতে চাই। ক্যাম্পাসকে সবুজ ও সৌন্দর্য বর্ধন করতে চাই। এখানে পাখি আসবে।”

বিশেষজ্ঞ এই শিক্ষক আরো বলেন, “আর কিছুদিন পর জীব বৈচিত্র্য রক্ষা, শিক্ষা ও গবেষণার জন্য একটি সৃমদ্ধ ল্যাবরেটরি তৈরি হবে। গাছপালা বড় হয়ে উঠলে জলবায়ু সহনশীলতা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং বাতাসের মান উন্নত করবে। কার্বণ নি:সরণে ভূমিকা রাখবে এখানকার বৃক্ষরাজি। বিভিন্ন পোকামাকড় ও পাখির আবাসস্থল তৈরি করে জীব বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করবে। জীব বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, কৃষি ও বনবিদ্যার শিক্ষার্থী এবং গবেষকরা একটি জীবন্ত শিক্ষা ক্ষেত্র পাবে।”

৩০ একরে অবকাঠামো নির্মাণের পর যেসব জায়গাগুলো ফাঁকা রয়েছে মূলত সেসব জায়গাতেই বনজ, ফলজ, ঔষধি, ছায়াদানকারী গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। যেসব গাছ এখন সচরাচর দেখা যাচ্ছে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এমন অসংখ্য চারা সংগ্রহ করে রোপণ করা হয়েছে। উপ-উপাচার্য বলেন, “আমাদের দেশ থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এমন অনেক দুর্লভ গাছের চারা। আমরা অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করে রোপণ করেছি। যেমন-ধুপ, উরি আম, মধুমাধবী, হাপরমালী, কানাইডিঙ্গা, বাঁশপাতা, নাগলিঙ্গম, রক্তন, চিকরাশি, বোলা, তমাল, নাইচিচা উদাল, বৈলাম, পুন্নাগ, কুসুম, কুরচি, মুচকুন্দচাঁপা, পালাম, রক্তরাগ, করঞ্জ, পরশপিপুল, কৃঞ্চবট, পলকজুই, বৃদ্ধ নারিকেল, নীল অঞ্জন, রয়না, রিঠা, কুম্ভী, আঁসফল ও পুত্রঞ্জীব।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাড়াও চারা রোপণে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন পুবালী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গাছ রোপণ করতে সহযোগিতা করেছে। ক্যাম্পাস যাতে পরিস্কার পরিছন্ন থাকে সেজন্য রোভার স্কাউট নিয়মিত পরিস্কার পরিছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নেয়। কর্তৃপক্ষ জীব বৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে লেকে মাছ অবমুক্ত করার পাশাপাশি কচ্ছপ ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন।

বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী হোসাইন আহমেদ বললেন, “রোপিত গাছের চারার সাথে সাথে বড় হবে আমাদের স্বপ্ন, সম্ভাবনা, অগ্রযাত্রা। ক্যাম্পাস হবে সামাজিক ও ব্যক্তিগত সময়ের জন্য আদর্শস্থান। ক্যাম্পাসের ছায়া ঘেরা পথ, ফুলের বাগান, প্রাণবন্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যত জীবনের স্বপ্ন দেখবে, ক্যারিয়ারের পরিকল্পনা করবে। এটি হবে ‘লিভিং ল্যাবরেটরি’।উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস আব্দুল আওয়াল বলেন, “দীর্ঘমেয়াদী রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে বৃক্ষ রোপণ করছি। এর মাধ্যমে পরিবেশগত উপকারিতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মননশীলতা ও সৃজনশীলতা বাড়াবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই ভবিষ্যতের জন্য আমাদের উদ্যোগ কাজে লাগবে। আমাদের ক্যাম্পাস ছড়িয়ে পড়বে দেশ থেকে দেশান্তরে। এই ক্যাম্পাসের আলোয় আলোকিত হবে পুরো বাংলাদেশ।”