আইন ও অপরাধ

মব সন্ত্রাস: ১৮৪ প্রাণের দায় কার 

দেশে মব সন্ত্রাস বা গণপিটুনির ঘটনা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ২০২৫ সালে সারা দেশে মব সন্ত্রাসের কারণে প্রাণ গেছে ১৮৪ জনের। সর্বশেষ শিকার ময়মনসিংহের ভালুকার দিপু চন্দ্র দাস। তাকে উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে হত্যা করে লাশ আগুনে পুড়িয়েছে।

বিচার ছাড়াই প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা, মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া কিংবা চরমভাবে নাজেহাল করার ঘটনাগুলো প্রশ্ন তুলছে—এই রক্তক্ষয়ী সহিংসতার দায় কার?  আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্বাস সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারহীনতা ও আইনের শাসনের অভাবে সাধারণ মানুষ নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।

২০২৫ সালের মব সন্ত্রাস ও জনরোষ সম্পর্কিত আলোচিত ঘটনা

ভালুকায় দিপু চন্দ্র দাস হত্যা: ময়মনসিংহের ভালুকায় দিপু চন্দ্র দাস (২৭) নামে এক পোশাক শ্রমিককে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গাছে ঝুলিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। 

দিপুর বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তবে তার কোনো সত্যতা পায়নি পুলিশ। যে পোশাক কারখানায় দিপু কাজ করতেন সেখানে সহকর্মীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে হত্যার শিকার হতে পারেন বলে জানিয়েছে পরিবার ও স্থানীয়রা।

পরিবারের ভাষ্য, এটি হঠাৎ কোনো উত্তেজিত জনতার ঘটনা নয়। পরিকল্পিতভাবে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তৈরি করে দিপুকে হত্যা করা হয়েছে।

ভালুকা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, 'এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণও আছে। ধর্মকে নিয়ে কটুক্তি করার যে অভিযোগ তোলা হয়েছে এখনো পর্যন্ত আমরা তদন্তে নিশ্চিত হতে পারিনি। জঘন্য এ অপরাধের সঙ্গে বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।”

ফরিদপুরে কবর থেকে লাশ তুলে আগুন: রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে 'তৌহিদি জনতা' পরিচয়ে নুরুল হক ওরফে 'নুরাল পাগলা' এর কবর, বাড়ি ও দরবার শরিফে হামলার ঘটনা ঘটে গত ৫ সেপ্টেম্বর। এমনকি মরদেহ কবর থেকে তুলে মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা।

বিয়ের দিন ঠিক করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত: রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় মেয়ের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে গিয়ে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন রূপলাল (৪০) ও প্রদীপ (৩৫) নামে দুই হরিদাস সম্প্রদায়ের লোক।

রূপলালের পরিবার ও স্থানীয় মানুষেরা জানান, ১০ আগস্ট মিঠাপুকুর উপজেলার শ্যামপুর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে রূপলালের বড় মেয়ে নূপুর রানীর বিয়ের দিন ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য ৯ আগস্ট মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে রূপলালের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন তাঁর ভাগনির স্বামী প্রদীপ দাস। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ দাস সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রূপলালকে ফোন করেন। রূপলাল সেখানে যান। তাঁরা দুজনে ভ্যানে চড়ে রূপলালের বাড়ি ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে রওনা হন। রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যানচোর সন্দেহে তাঁদের দুজনকে থামান স্থানীয় কয়েকজন। এরপর সেখানে লোক জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে মব তৈরি করে রূপলাল দাস ও প্রদীপ দাসকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় রূপলালের স্ত্রী হত্যা মামলা করেন এবং পুলিশ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।

পাথর দিয়ে শরীর থেঁতলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় লাল চাঁদকে: ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯)। হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। তার শরীরের ওপর উঠে লাফায় কেউ কেউ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও গণপিটুনিতে হত্যা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে (ঢাবি) বলা হয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। সেখানেও গণপিটুতে হত্যার মতো ঘটনা ঘটে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাবির ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।  

২৩ নভেম্বর দিবাগত রাত দুইটার দিকে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের দেবীনগর গ্রামে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে শাহিন শিকদার নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।  এ সময় তার আরো তিন সহযোগীকে গণপিটুনি দিলে আহত হয়। 

গত ২২ জুন ঢাকার উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাকে উশৃঙ্খল জনতা মারধর ও চরমভাবে নাজেহাল করে। তবে খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পুলিশ সদস্যরা পৌঁছে তাকে উদ্ধার করে। পরে ওই ঘটনায় পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অপরাধে।

আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) এর তথ্য মতে, মব তৈরি ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে ১৮৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। 

তথ্য মতে, মব সন্ত্রাসে ঢাকায় ৭৮, খুলনা ১৯, রাজশাহী ১৪, রংপুর ১২, সিলেট ৪, চট্টগ্রাম ৩২ বরিশাল ১৫ ও ময়মনসিং ১০ জন নিহত হয়েছেন। মব সন্ত্রাস কিংবা গণপিটুনির শিকার হয়ে প্রায় চার শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে হত্যা করা আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ সংবিধানের ৩১, ৩২ ধারায় প্রত্যেক নাগরিকের আইনগত সুরক্ষা ও জীবন রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

আসক বলছে, গণপিটুনিতে হত্যা করার মতো ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে। দেশের সব নাগরিকের মধ্যে গভীর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সামাজিক সম্প্রীতি আইনের শাসনের জন্য উদ্বেগের। যেকোনো সংঘবদ্ধ প্ররোচনা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষকে দায় মুক্তি না দিয়ে তাদের শনাক্ত করে কঠোরভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এসব ঘটনা কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহনীর দুর্বলতা নয়, বরং ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতি জন আস্থার সংকটকেও স্পষ্ট করে তুলেছে, যা আমাদের জন্য এক ভয়ঙ্কর বার্তাও।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “মব সন্ত্রাস কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, সে যে দল বা মতের হোক না কেন। আইনের দৃষ্টিতে সে অপরাধী। আমরা অপরাধীদের কঠোর বার্তা দিতে চায়, মব সন্ত্রাসরোধে পুলিশ জোরালোভাব কাজ করছে।”

হিউম্যান রাইট সাপোর্ট সোসাইটির (এইচ আর এস এস) হিসাবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মে পর্যন্ত ৯ মাসে মব সন্ত্রাস ঘটেছে ২০২টি। এসব ঘটনায় ১৩১ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ১৬৫ জন। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারবহির্ভূতভাবে শাস্তি দেয় বা হত্যা করে, তখন তাকেই গণপিটুনি বলা হয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, গুজবের বিস্তার এবং আইনের প্রতি আস্থাহীনতা এই বর্বরতাকে উস্কে দিচ্ছে। যখন একদল মানুষ একত্রিত হয়ে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করছে।  আবার বেশিরভাগ গণপিটুনির মূলে থাকে গুজব (যেমন: ছেলেধরা বা চোর সন্দেহে)। ফেসবুক বা ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ যাচাই না করেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, মব সন্ত্রাসের জন্য দায় সরকারের দৃঢ় অবস্থানের অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর উদাসীনতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকার অভাব রয়েছে। এখনই মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে দিন দিন তা আরো বাড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, “পুলিশ ও প্রশাসনকে আরো তৎপর হতে হবে। যেকোনো ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। গুজব প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রচার চালাতে হবে। ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’—এই বার্তাটি তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। নৈতিক শিক্ষা ও সহনশীলতার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। তা না হলে এই পরিস্থিতি থেকে সরে এসে নিরাপত্তা ব্যবস্থার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা শেষ করে দেবে এই মব ভায়োলেন্স।”

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, “মব ভায়োলেন্স দূর করতে সরকারের সদিচ্ছাটা জরুরি। এছাড়া, কেউ হত্যাকাণ্ড ঘটালে তার কঠোর শাস্তি বিধান রয়েছে সেটি যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।”

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মুনতাসির মারুফ বলেন, “অনভিপ্রেত, আকস্মিক সহিংসতা ব্যক্তির জন্য এক বিপর্যয়কর অভিজ্ঞতা। এরকম অভিজ্ঞতা মানুষের চিন্তা জগৎকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়, মনে চাপ সৃষ্টি করে। ব্যক্তির শারীরিক ও স্বাস্থ্যের হানি ঘটায়।”