একসময় ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, শুটিং ফ্লোর আর সোশ্যাল মিডিয়ার আলোয় নিয়মিত ছিলেন তারা। কেউ অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে সরব ছিলেন, কেউ আবার সরাসরি দলীয় মনোনয়ন কিনে সংসদ সদস্যও হয়েছেন। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, হঠাৎ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দৃশ্যপট বদলে যায়।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় থাকা দেশের শোবিজ অঙ্গনের একাধিক পরিচিত মুখের আর দেখা মেলেনি। কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে গুঞ্জন, কেউ দেশে থেকেই নিজেকে আড়ালে রেখেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া, শুটিং সেট কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে—২০২৫ সালের পুরোটা সময়জুড়েই তাদের কোনো উপস্থিতি চোখে পড়েনি। চলুন দেখে নেওয়া যাক, শোবিজ থেকে রাজনীতির মাঠে নেমে বছরজুড়ে অন্তরালে থাকা সেই আলোচিত মুখগুলো কারা—
ফেরদৌস: এমপি থেকে নিখোঁজ এই তালিকার শীর্ষেই রয়েছেন ঢালিউড চিত্রনায়ক ফেরদৌস। আওয়ামী লীগের হয়ে ঢাকা-১০ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঠিক আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাকে দেখা গেছে বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও দলীয় আয়োজনে। তবে ৫ আগস্টের পর থেকেই পুরোপুরি আড়ালে তিনি। কখনো গুঞ্জন ওঠে তিনি ভারতে গিয়ে বন্ধু ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের বাসায় অবস্থান করছেন, কখনো আবার শোনা যায় যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তবে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তার কোনো উপস্থিতি নেই। কোথায় আছেন—তা অজানাই রয়ে গেছে।
নিপুণ আক্তার: আলোচনা-সমালোচনার পর নীরবতা চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার আলোচনায় আসেন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এরপর রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং নানা কর্মসূচিতে সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। পটপরিবর্তনের পর যুক্তরাজ্যে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গোয়েন্দা সংস্থার আপত্তিতে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর একটি অনুষ্ঠানে কয়েক সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা গেলেও তার অবস্থান নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। ২০২৫ সালে তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি।
ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর: নীরব অন্তরাল অভিনেত্রী উর্মিলা শ্রাবন্তী কর দীর্ঘদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া ও অভিনয়—দু’দিক থেকেই দূরে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেন জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী। ২০২৫ সালজুড়ে তার কোনো কর্মতৎপরতার খোঁজ মেলেনি।
তারিন জাহান: রাজনীতির দুই মেরু পেরিয়ে নিঃশব্দ একসময় ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারিন জাহান আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হননি। তবে আওয়ামী লীগই নয়, বিএনপির আমলেও জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সরকার পতনের পর থেকেই কোথাও নেই তারিন। প্রকাশ্যে কোনো উপস্থিতি বা বক্তব্য—কিছুই নেই।
রিয়াজ: বিদেশযাত্রা ব্যর্থ, এরপর নীরবতা গণঅভ্যুত্থানের পর চিত্রনায়ক রিয়াজ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে গিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা ছিল তার। আওয়ামী লীগের কোনো আনুষ্ঠানিক পদে না থাকলেও দীর্ঘদিন দলটির পক্ষে সরব ছিলেন তিনি। এরপর থেকেই তাকে ঘিরে ‘পালিয়ে যাওয়ার’ গুঞ্জন ছড়ালেও প্রকাশ্যে আর দেখা মেলেনি।
মামলা আর অনিশ্চয়তার ছায়া এদিকে জুলাই আন্দোলন ঘিরে করা মামলায় শোবিজ অঙ্গনের অন্তত ২৯ জন শিল্পীকে আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তিনটি মামলায় যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন—নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তার, কামরুন নাহার শাহনূর, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, সোহানা সাবা, তানভীন সুইটি, কৌশিক হোসেন তাপস, মেহের আফরোজ শাওন, জাকিয়া মুন, জ্যোতিকা জ্যোতি, সুবর্ণা মুস্তাফা, আশনা হাবিব ভাবনা, রোকেয়া প্রাচী, তারিন জাহান, অরুণা বিশ্বাস, মমতাজ, শামীমা তুষ্টি, শমী কায়সার, সাজু খাদেম, জায়েদ খান, ফেরদৌস, রিয়াজ, চঞ্চল চৌধুরী, আজিজুল হাকিম, সাইমন সাদিক ও ইরেশ যাকেরসহ অনেকে।
২০২৫ সালজুড়ে শোবিজ অঙ্গনের এসব পরিচিত মুখ যেন রয়ে গেলেন এক অদ্ভুত নীরবতায়। একসময় যারা আলো-আলোচিত রাজনীতির মাঠে ছিলেন, তারা আজ কোথাও নেই—না পর্দায়, না রাজপথে, না সামাজিক মাধ্যমে। সালতামামির পাতায় তাই প্রশ্ন থেকেই যায়—এই নীরবতা কি সাময়িক, না কি শোবিজ-রাজনীতির এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি?