খেলাধুলা

৪৫ বছরের খরা কাটিয়ে এশিয়ার মঞ্চে বাংলাদেশ

ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বিদায় নিতে যাওয়া বছরটিতে দক্ষিণ এশিয়ার আঙিনা ছাড়িয়ে এশিয়ার মানচিত্রে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের জানান দিয়েছিল বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। দীর্ঘ সাড়ে চার দশকের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এশিয়ান কাপের মূল আসরে জায়গা করে নিয়েছিল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। ২০২৫ সালটি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে মূলত আফঈদা-ঋতুপর্ণাদের এই অভাবনীয় সাফল্যের কারণে। চলুন সেটা আরেকবার রোমন্থন করা যাক সালতামামির আতশিকাচে—

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দুবারের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার পর এবার মিশন ছিল ‘এএফসি নারী এশিয়ান কাপ বাছাই’। মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে সেই পরীক্ষায় লেটার মার্কস নিয়ে উত্তীর্ণ হয় কোচ পিটার বাটলারের শিষ্যরা। তাতে লাল-সবুজের প্রমিলা ব্রিগেড পা রাখে এমন এক উচ্চতায়, যা গত ৪৫ বছরে দেশের কোনো ফুটবল দল ছুঁতে পারেনি।

সব বাধা মাড়িয়ে ২০২৬ সালের এএফসি এশিয়ান কাপের মূল মঞ্চে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। এই অর্জন কেবল একটি টুর্নামেন্টে সুযোগ পাওয়া নয়, বরং বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক উত্থান।

মিয়ানমার জয় ও এশিয়ান কাপের টিকিট বাছাইপর্বে বাংলাদেশ ছিল গ্রুপ ‘বি’-তে। যেখানে প্রতিপক্ষ ছিল স্বাগতিক মিয়ানমার, বাহরাইন ও তুর্কমেনিস্তান। বাহরাইনকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ নিজেদের শক্তির পরিচয় দেয় মিয়ানমারের বিপক্ষে। ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা পরাশক্তি মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। অথচ এই মাঠেই ২০১৮ সালে ৫-০ গোলে হেরেছিল টাইগ্রেসরা। সবশেষে তুর্কমেনিস্তানকে ৭ গোলে ভাসিয়ে উৎসবের পূর্ণতা দেয় আফঈদার দল। ১৯৮০ সালে পুরুষ দলের পর বাংলাদেশ থেকে প্রথম কোনো দল হিসেবে এই এলিট আসরে নাম লেখাল তারা।

রেকর্ড ও ঋতুপর্ণা-ম্যাজিক বাছাইপর্বের ৩ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে মোট ১৬টি গোল উৎসব করেছে বাংলাদেশ। যার মধ্যে একাই ৫ গোল করে লাইমলাইটে ছিলেন ‘বাংলাদেশের মেসি’ খ্যাত ঋতুপর্ণা চাকমা। তার আগ্রাসী ফুটবল আর ড্রিবলিং এশীয় সংবাদমাধ্যমগুলোরও নজর কেড়েছে। তখন ঋতুপর্ণা বলেছিলেন, “আমরা জানি কঠিন পরিস্থিতিতে কীভাবে লড়াই করতে হয়। আমাদের লক্ষ্য এখন কেবল এশিয়া নয়, বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া।”

বিদ্রোহ থেকে বিজয়: তারুণ্যের জয়জয়কার এই ঐতিহাসিক সফরের ঠিক আগমুহূর্তে ফুটবলে যেন ঝড় বয়ে গিয়েছিল। কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে অভিজ্ঞ কয়েকজন ফুটবলারের বিদ্রোহের কারণে দলের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ছিল টালমাটাল। তবে সাহসের সাথে সেই অভিজ্ঞদের বদলে একঝাঁক প্রতিভাবান তরুণীকে নিয়ে দল সাজান বাটলার। ফলাফল? মাঠের লড়াইয়ে বাজিমাত!

এশীয় মঞ্চ থেকে ব্রাজিলের পথে ২০২৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় বসবে এশীয় ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসর। ২৩তম দেশ হিসেবে এই আসরে নাম লেখানো বাংলাদেশের জন্য এটি কেবল এশিয়ার লড়াই নয়, বরং ২০২৭ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের প্রবেশদ্বার।

অস্ট্রেলিয়ার এই আসরে সেমিফাইনালে পৌঁছাতে পারলে মিলবে সরাসরি বিশ্বকাপের টিকিট।  কোয়ার্টার ফাইনালে হোঁচট খেলেও বিদায় নয়, থাকবে প্লে-ইন ম্যাচের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে যাওয়ার শেষ সুযোগ।

পরিকল্পনায় আগামীর স্বপ্ন চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো জায়ান্টদের সঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশই প্রথম দল হিসেবে বাছাইপর্ব থেকে মূল পর্বে নাম লিখিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সীমিত সুযোগ-সুবিধার মাঝে এই অর্জন এ দেশের ফুটবলের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সাবিনা-আফঈদা-ঋতুপর্ণাদের ঘিরে এখন সমগ্র বাংলাদেশের একটাই অঙ্গীকার আর স্লোগান- ‘মিশন অস্ট্রেলিয়া’।

অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে ব্রাজিলের বিশ্বকাপের টিকিট ছিনিয়ে আনার এই মহাযাত্রা এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। ২০২৬ সালে সেই অপেক্ষার পালা ফুরিয়ে নতুন এক ইতিহাস গড়বে বাংলাদেশের নারী ফুটবলরারা; তেমনটাই প্রত্যাশা দেশের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীদের।