জাতীয়

উন্নয়ন সত্ত্বেও বিতর্কিত মেগা প্রকল্পের জন্য আলোচনায় ছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়

চলতি বছর দেশের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের জন্য কেবল একটি সাধারণ বছর ছিল না, বরং এটি ছিল আমূল সংস্কার এবং জনবান্ধব নীতি বাস্তবায়নের এক বৈপ্লবিক সময়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার যখন ২০২৫ সালে মন্ত্রণালয়টি অভাবনীয় কিছু অর্জন এবং সাহসী সংস্কারের মধ্য দিয়ে এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে। তবে বিতর্ক ছিল মেগা প্রকল্প নিয়ে। 

এই মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার জেলা কুমিল্লার সড়ক ও অন্যান্য গ্রামীণ অবকাঠামো মেরামত ও উন্নয়নে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।

এ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় আসিফ মাহমুদের নিজ উপজেলা মুরাদনগরে (৪৫৩ কোটি টাকা)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর উপজেলা দেবীদ্বারে (৩৩৮ কোটি টাকা)।  যা নিয়ে হয় সমালোচনা। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ অন্তর্বর্তী সরকারে প্রথমে শ্রম ও ক্রীড়া উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে ছিলেন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। তিন মাসের মাথায় হাসান আরিফকে সরিয়ে স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হয় আসিফ মাহমুদকে। তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করেন। 

এছাড়া, সাতক্ষীরায় ‘জেলা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন’ ২,১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মহলে বিতর্ক তৈরি করেছে। মোট ৪,৫৯৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ দেশের অন্যান্য জেলায় যে তুলনায় বেশি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

বাজেটে বিশাল বরাদ্দ ও আর্থিক দূরদর্শিতা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় সরকার খাতে ৪২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছরে এই খাতে বাজেটের পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যখন এই বাজেট পেশ করেন, তখন তিনি স্পষ্ট করেন যে, যদিও পরিমাণ কিছুটা কম মনে হতে পারে, কিন্তু প্রতিটি টাকার ব্যবহার হবে স্বচ্ছ এবং জনকল্যাণমুখী। যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, পরিবেশ উন্নয়ন এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা এই পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয় আগামী বছরের কর্মপরিকল্পনা।

দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রকল্পের মহাযজ্ঞ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৩টি বড় প্রকল্প অনুমোদন করেছে, যার মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৩২,৭৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিওবি অর্থায়নে ১২,৩৬২ কোটি এবং বৈদেশিক অর্থায়নে ২০,৩৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ ও শহর অবকাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আসছে।

প্রধান কার্যক্রমের খতিয়ান, সড়ক ও যোগাযোগ গ্রামীণ রাস্তার নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে ৮২৯.৬৯ কিলোমিটার। এছাড়া, সড়ক উন্নয়ন ও ইউনিব্লক দ্বারা প্রশস্তকরণ হয়েছে ২,৬৬০.৩৩১ কিমি। ৬,১৩৫.৬২ মিটার দীর্ঘ সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন জনপদগুলোকে মূল ধারায় যুক্ত করা হয়েছে।

একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে, গ্রামীণ ও শহরতলির অবকাঠামো উন্নয়নে রেকর্ডসংখ্যক মাইলফলক অর্জিত হয়েছে।

গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম করতে এবং কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণে গতি আনতে ৮২৯.৬৯ কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা নতুনভাবে নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। এর ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে উপজেলা ও জেলা সদরের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সড়ক উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন (ইউনিব্লক প্রযুক্তি) স্থায়িত্ব বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব যাতায়াত নিশ্চিত করতে প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। মোট ২,৬৬০.৩৩১ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ করা হয়েছে। বিশেষ করে টেকসই ও দৃষ্টিনন্দন ইউনিব্লক দ্বারা সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পটি যাতায়াতকে করেছে আরো আরামদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী। এটি ভারী যান চলাচলের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাস্তার স্থায়িত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে নতুন দিগন্ত এই মেয়াদে মোট ৬,১৩৫.৬২ মিটার দীর্ঘ বিভিন্ন সেতু ও কালভার্ট সফলভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এই অবকাঠামোগুলো শুধু চলাচলের পথ নয়, বরং বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এর ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জরুরি সেবার পরিধি এখন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। 

দুর্যোগ মোকাবিলা: ৪৪৬টি দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, যা উপকূলীয় মানুষের জীবন রক্ষায় ঢাল হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রতি বছরই উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে উপকূলের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় ৪৪৬টি আধুনিক দুর্যোগ আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই কেন্দ্রগুলো কেবল ইট-সিমেন্টের দালান নয়, বরং দুর্যোগের সময়ে অসহায় মানুষের জন্য এক একটি 'নিরাপদ জীবন রক্ষাকারী ঢাল'। নতুন নির্মিত এই আশ্রয় কেন্দ্রগুলো কেবল দুর্যোগকালীন সময়ের জন্যই নয়, বরং বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। 

নগর আধুনিকায়ন ও নাগরিক সেবা একটি আধুনিক ও বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার প্রধান শর্ত হলো উন্নত অবকাঠামো এবং নিরবচ্ছিন্ন নাগরিক সুবিধা। সাম্প্রতিক সময়ে নগর আধুনিকায়নের যে কর্মযজ্ঞ চলছে, তাবে জনজীবনে গতির পাশাপাশি নিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সড়ক বাতি স্থাপন, বিনোদন কেন্দ্রের উন্নয়ন এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন নগরীকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে আলোকায়ন প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ৫৯৫ কিলোমিটার নতুন স্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি জননিরাপত্তা বজায় রাখতে মেরামত করা হয়েছে ১৪,৯৬০টি অকেজো বাতি। যাতায়াত ব্যবস্থা ও বাণিজ্যের প্রসারে ১০টি আধুনিক বাস টার্মিনাল এবং ১০টি সুপার মার্কেট নির্মাণের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। কেবল নগরের যান্ত্রিকতা নয়, নাগরিকদের মানসিক প্রশান্তির কথা মাথায় রেখে ১০টি আধুনিক পার্ক নির্মাণের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে, যা শহরের ফুসফুস হিসেবে কাজ করবে। এদিকে একটি স্বাস্থ্যসম্মত নগরী গড়ে তুলতে আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ২,০০৪টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে, যা পথচারী ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ অনেকাংশে লাঘব করেছে। বর্জ্য অপসারণের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১,৯৯৮.৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন লাইন। এর ফলে জলাবদ্ধতা নিরসন এবং পরিবেশ দূষণ রোধে বড় ধরনের সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

অপর দিকে সুপেয় পানি নিশ্চিত করা যেকোনো নগর কর্তৃপক্ষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ৮১,০৯৪ কিমি দীর্ঘ বিশাল বিতরণ পাইপলাইন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছে। এই অবকাঠামোর মাধ্যমে প্রায় ৫,২৫,০০০ মানুষের বাড়িতে সরাসরি পানির সংযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এটি কেবল একটি সংখ্যা নয়, বরং জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় একটি বড় মাইলফলক। পরিকল্পিত নগরায়ন ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার এই সমন্বয় নাগরিক জীবনকে করেছে আরো সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। এই উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্মার্ট নগরে পরিণত হবে। টেকসই উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে একটি উন্নত ও আধুনিক নগর কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

সংস্কার ও বিশেষ উদ্যোগ জুলাই ২০২৫ সালের অর্জন কেবল ইটের দালান বা পিচঢালা রাস্তায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি চেতনার পুনর্জাগরণের বছর। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মন্ত্রণালয় বেশ কিছু ‘হৃদয়স্পর্শী’ পদক্ষেপ নিয়েছে।

স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ৪৫৮টি স্থানে 'স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প' স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকার ওসমানী উদ্যানে নির্মিত হচ্ছে 'জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ'। মেট্রোরেল পিলারে গ্রাফিতির মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ও বিপ্লবের ৩৬ দিনকে ধরে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শহীদ পরিবারকে সম্মানার্থে শাপলা চত্বর ও মোদি বিরোধী আন্দোলনের ৭৭ শহীদ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে মোট ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকার অনুদান প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দুটি বাস উপহার দেওয়া হয়েছে। সাংস্কৃতিক সংস্কারের জন্য ঐতিহ্যবাহী ঈদের মিছিল পুনরায় চালু করা এবং আবরার ফাহাদ স্মরণে পলাশীর মোড়ে 'আগ্রাসন বিরোধী আটস্তম্ভ' উদ্বোধন করা হয়েছে। এছাড়া ১৪৭টি স্থাপনা ও প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে।

উন্নয়ন ও বিতর্কের দোলাচল উন্নয়নের এই বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যে কিছু বিষয় আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার তিনটি সংসদীয় আসনে (ঢাকা-৯, ১০ ও ১১) ২৭৪টি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ৮ কোটি ২৯ লাখ টাকার বিশেষ বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাবেক স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জানিয়েছেন, এটি কোনো বিশেষ সুবিধার জন্য নয়, বরং আবেদনের প্রেক্ষিতে সাধারণ প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে। পাশাপাশি, নিজ জেলা কুমিল্লায় ২,৪০০ কোটি এবং সাতক্ষীরায় ২,১৯৮ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ মহলে বিতর্ক চললেও প্রশাসনের দাবি, এই অঞ্চলগুলো দীর্ঘকাল উন্নয়নের আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। কুমিল্লার মুরাদনগরে ৪৫৩ কোটি টাকার বরাদ্দ উপজেলাটিকে এক আধুনিক রূপ দেবে। সাতক্ষীরার মৎস্য সম্পদ ও কৃষি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ২,১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্পটি হবে গেমচেঞ্জার হবে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।