২০২৫ সালটি বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে একটি অত্যন্ত উত্তাল ও সংঘাতময় বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই বছরটি একদিকে যেমন পুরোনো যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছে, অন্যদিকে নতুন নতুন ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ ও সরাসরি সামরিক সংঘাতের সাক্ষী হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খুব গর্বের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দাবি করেছেন, তিনি চলতি বছরে অন্তত ৮টি যুদ্ধের মীমাংসা করেছেন এবং বিশ্বজুড়ে ‘লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন।
বিশ্ব অবশ্য তার এই দাবিগুলোকে কিছুটা সন্দেহের চোখেই দেখছে, আর এই অবিশ্বাসের পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণও রয়েছে।
গাজায় ১০ অক্টোবর থেকে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েল নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে চলেছে। ট্রাম্প জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অথচ কোনো বিরতি ছাড়াই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।
থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘর্ষ সাময়িক বিরতির পর আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর সুদানের গৃহযুদ্ধ ইতিহাসের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বেসামরিক বাস্তুচ্যুতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে দেশটির সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর লড়াইয়ের মাঝে পড়ে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন।
এই বছরে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধেও উত্তেজনার পারদ চড়তে দেখা গেছে, অন্যদিকে হাইতিতে গ্যাং সহিংসতা এবং সশস্ত্র সংঘাতের ফলে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা এক নজিরবিহীন ঘটনা।
ইসরায়েল ও ইরান যুদ্ধ বন্ধ করলেও এবং ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চার দিনের মাথায় মিটে গেলেও, এই দেশগুলোর মধ্যে শান্তি এখনো খুবই ভঙ্গুর।
যুদ্ধে এবং সংঘর্ষে নিহত মানুষের সংখ্যা এই বছর নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় লেখক ও ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত বিশেষজ্ঞ ড্যান স্টেইনবুক ২০২৫ সালকে সংক্ষেপে ‘খুবই অন্ধকারময়- মানবিক সংকট ও অর্থনৈতিক ক্ষতির’ বছর হিসেবে অভিহিত করেছেন। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই বিপুল প্রাণহানি ‘উপযুক্ত আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে এড়ানো সম্ভব ছিল’।
স্টেইনবুকের মতে, “অতীতে ধারণা করা হতো যে পৃথিবীতে আর কখনো গণহত্যা ঘটবে না। কিন্তু গাজায় দিনরাত দুই বছর ধরে এই ধরনের নৃশংসতা চলতে পারার ঘটনাটি সম্ভবত ভবিষ্যতে আরো খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।”
স্টেইনবুকের এই আশঙ্কাজনক পূর্বাভাস অবশ্য অমূলক নয়। কারণ একদিকে বিশ্বে নতুন নতুন ফাটল তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে স্বঘোষিত ‘শান্তি স্থাপনকারী’ ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছেন।
এই প্রতিবেদনে এই বছরের সবচেয়ে বড় সংঘাতগুলোর একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো, যা বছরটিকে কলঙ্কিত করেছে এবং সম্ভবত আগামী বছরের জন্যও একটি নেতিবাচক সুর বেঁধে দিয়েছে।
গাজার জন্য ‘সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর’
যুক্তরাষ্ট্রের ২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা উন্মোচন এবং এরপর জাতিসংঘ ও তুরস্কের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সমর্থনে ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি গাজা এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ অবসানের আশা জাগিয়েছিল।
কিন্তু ইসরায়েল আসলে যুদ্ধের কৌশল বদলেছে মাত্র; তারা অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা অব্যাহত রেখেছে এবং যুদ্ধবিরতির পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মানুষকে হত্যা করেছে।
এই সাম্প্রতিক মৃত্যুগুলোর ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় মোট নিহতের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের ছয় দিনের যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনিদের কাছে ২০২৫ সালই ‘সবচেয়ে প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক বছর’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি নিয়ে যখন বড়সড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা দিয়েছে, তখন বিভিন্ন ইঙ্গিত বলছে যে, অবরুদ্ধ এই এলাকায় নিহতের সংখ্যা ১ লাখ পর্যন্ত হতে পারে- যা ইসরায়েলের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের চরম মানবিক বিপর্যয়কেই তুলে ধরে।
তবে বিশ্লেষক এবং বিশেষজ্ঞরা ফিলিস্তিনি জনগণের অদম্য মনোবলের কথা উল্লেখ করেছেন, যা মূলত নেতানিয়াহু সরকারকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তেহরানভিত্তিক ইরানি সাংবাদিক ফাতেমেহ করিমখানের মতে, গাজা যুদ্ধবিরতি ছিল এই বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ঘটনা।
তিনি বলেন, “ইসরায়েলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এবং মার্কিন সমর্থন সত্ত্বেও তেল আবিব গাজা পুরোপুরি ‘দখল’ করতে সফল হয়নি। বরং তারা যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে জায়নবাদী ‘যুদ্ধযন্ত্র’ এই ময়দানে একমাত্র খেলোয়াড় নয়।”
ফিলিস্তিনি লেখক ও বিশ্লেষক রামজি বারুদ একটি ‘উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন’ দেখতে পাচ্ছেন, যেখানে অনেক দেশ নেতানিয়াহু সরকারের কর্মকাণ্ডের কারণে তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে।
তার মতে, “ফিলিস্তিনিদের শক্তি এবং তারা যে বিশ্বব্যাপী সংহতি তৈরি করেছে, তা ইসরায়েলপন্থি সব পশ্চিমা প্রচারণার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।”
তিনি বলেন, “গাজায় ইসরায়েল একটি কঠিন শিক্ষা পেয়েছে: তাদের বিশাল সামরিক শক্তি, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের পূর্ণ সমর্থন থাকলেও, রাজনৈতিক ফলাফল নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।”
ইসরায়েল সরকার গাজায় যুদ্ধবিরতির মধ্যেও হামলা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে অধিকৃত পশ্চিম তীরের বেশ কিছু এলাকা বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা চলছে।
পশ্চিম তীরে অর্থাৎ দখল করা ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও অবৈধ বলে মনে করে।
ইউক্রেনে অচলাবস্থা
২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ২০২৫ সালেও অব্যাহত রয়েছে। তিন বছর আগে রাশিয়ার একটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ বর্তমানে শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ ছাড়াই একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধে পরিণত হয়েছে- যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বৃহত্তম সামরিক সংঘাত।
যুদ্ধ শেষ করার জন্য ট্রাম্পের প্রবল চাপ এবং তাড়াহুড়ো সত্ত্বেও- যার মধ্যে হোয়াইট হাউজে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে প্রকাশ্যে তিরস্কার করার মতো ঘটনাও ছিল- ২০২৫ সাল প্রকৃতপক্ষে মস্কো এবং কিয়েভ উভয় পক্ষকেই রণক্ষেত্রে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছে।
একটি স্বাধীন সংঘাত পর্যবেক্ষণকারী গোষ্ঠীর অনুমান অনুযায়ী, এই বছর উভয় পক্ষের সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকসহ প্রায় ৭৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, যা বর্তমানে বিশ্বের সব সংঘাতের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রাণহানি।
ভিলনিয়াসভিত্তিক ‘জিওপলিটিক্স অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ সেন্টার’-এর প্রধান নির্বাহী লিনাস কোজালা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের জেলেনস্কি-ট্রাম্পের বৈঠককে যুদ্ধের ‘সবচেয়ে অস্থিতিশীল মুহূর্ত’ হিসেবে দেখছেন, যার প্রভাব পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ওপরও পড়েছে।
কোজালার মতে, “সেই ঘটনাটি পশ্চিমা ঐক্য এবং ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন প্রতিশ্রুতি নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।”
ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে আর্থিক সহায়তা স্থগিত করার পর, ২০২৫ সালে মিত্রদের সম্মিলিত সহায়তার পরিমাণ কমে প্রায় ৩২.৫ বিলিয়ন ইউরোতে দাঁড়িয়েছে। অথচ ২০২২-২০২৪ সময়কালে ইউক্রেনে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বার্ষিক পশ্চিমা সহায়তার গড় ছিল প্রায় ৪১.৬ বিলিয়ন ইউরো।
ইউক্রেন এবং সেই সঙ্গে ইউরোপের জন্য ট্রাম্পের এই দাবি- যে যুদ্ধ শেষ করতে কিয়েভকে মস্কোর কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে হবে- তা কেবল এই মহাদেশের জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করতে পারে।
আগস্ট মাসে আলাস্কায় একটি শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে ট্রাম্পের উষ্ণ অভ্যর্থনা অনেক ইউরোপীয় নেতাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
বছরের বেশিভাগ সময়জুড়ে ‘শান্তি’ যেন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউক্রেন এবং পুতিনকে কোণঠাসা করার চেষ্টায় থাকা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে পিং-পং বলের মতো ঘুরপাক খেয়েছে- যেহেতু ওয়াশিংটন ইউক্রেনীয়, রুশ এবং ইউরোপীয় রাজধানীগুলোর মধ্যে বারবার মার্কিন শান্তি প্রস্তাবগুলো আদান-প্রদান করছিল।
ট্রাম্প পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের প্রতিই আক্রমণাত্মক ও নমনীয়- এই দ্বিমুখী আচরণ করেছেন। অতি সম্প্রতি তিনি একটি ২৮-দফার শান্তি পরিকল্পনা পেশ করেছেন, যার বিপরীতে ইউরোপ একটি পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছে। ইউরোপ বিশ্বাস করে, এই পাল্টা প্রস্তাব ইউক্রেনের জন্য এক ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত চাপের মুখে জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মীমাংসার পথ খোঁজার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন।
তবে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করবে না, কারণ রাশিয়ার দাবিগুলো এখনও সর্বোচ্চবাদী এবং মৌলিকভাবে অযৌক্তিক।”
বিশেষজ্ঞেদের মতে, ‘যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে, এটি যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ সম্পর্ককে তত বেশি পরীক্ষার মুখে ফেলবে।’
লিনাস কোজালার মতে, “মূল প্রশ্ন হলো- যুক্তরাষ্ট্র কি ইউরোপকে ক্রমবর্ধমানভাবে মিত্রদের মহাদেশ হিসেবে দেখছে, নাকি একগুচ্ছ প্রতিযোগী বা এমনকি প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছে? এই পার্থক্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিদ্যমান ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্কের প্রকৃতিকে আমূল বদলে দিতে পারে।”
১২ দিনের যুদ্ধ
ইসরায়েল ২০২৫ সালের অন্যতম নাটকীয় উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটায়। তারা ইরানের বিভিন্ন শহর এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি এই যুদ্ধে টেনে আনে। অন্যদিকে, তেহরানও ইসরায়েলের ওপর ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে দেশটিকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
ইসলামাবাদভিত্তিক ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আইমেন জামিল বলেন, “এই ১২ দিনের যুদ্ধ ‘তেহরান ও তেল আবিবের মধ্যে কয়েক দশকের কৌশলগত অস্পষ্টতা এবং ছায়াযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছে।” তার মতে, এটি ছিল ‘২০২৫ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ঘটনা।’
গত দুই বছরে গাজা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বাড়ার পাশাপাশি ইসরায়েল ইরানের ‘প্রতিরোধের অক্ষ’- লেবাননের হিজবুল্লাহ থেকে শুরু করে ইয়েমেনের হুথি পর্যন্ত- সবগুলো পক্ষকেই ক্রমাগত আক্রমণ করে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।
ইসরায়েল যখন ইরানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ‘মিডনাইট হ্যামার’ ছদ্মনামের একটি অভিযানের মাধ্যমে এই যুদ্ধে সরাসরি যোগ দেয়। তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা এবং টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। তেল আবিবের দাবি, ইরান এই স্থাপনাগুলোতে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে তা পরিষ্কার না হলেও, এই ১২ দিনের যুদ্ধ পুরো অঞ্চলকে এক চরম অস্থিরতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এবং একটি বৃহত্তর যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোহাম্মদ এসলামির মতে, এই যুদ্ধ ইসরায়েলের বহুল প্রশংসিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’-এর সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতাগুলোকেও উন্মোচিত করেছে।
এসলামি বলেন, এই যুদ্ধ আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যের সমীকরণ বদলে দিয়েছে, যেখানে ‘কার্যকরী স্তরে পরাশক্তিগুলোর বড় ধরনের অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।’
তিনি আরো যোগ করেন, “ইরানের নির্দিষ্ট কিছু স্থাপনায় মার্কিন হামলা এবং উত্তেজনা প্রশমনে ওয়াশিংটনের কেন্দ্রীয় ভূমিকা এই যুদ্ধের কৌশলগত গুরুত্বকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে।”
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা অদূর ভবিষ্যতে আরো সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ পুনর্গঠনের পাশাপাশি অঞ্চলের সমৃদ্ধ জ্বালানি বাজারেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
সুদানের বিপর্যয়
চলতি বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘ সুদানের গৃহযুদ্ধকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে চলমান বিধ্বংসী এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন এর দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ এবং আনুমানিক ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
২০২৩ সালের এপ্রিলে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের নেতৃত্বাধীন সুদানের সেনাবাহিনী এবং মোহাম্মদ হামদান দাগালোর নেতৃত্বাধীন আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-এর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। এটি দ্রুত একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয় এবং সন্দেহাতীতভাবে ২০২৫ সালটি ছিল এই সংঘাত শুরুর পর থেকে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী বছর।
সুদানের উত্তর দারফুর রাজ্যের রাজধানী আল-ফাশির-এ ১৮ মাসের অবরোধ এবং পরবর্তীতে শহরটি দখলের সময় আরএসএফ-এর বিরুদ্ধে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
সুদান ও হর্ন অব আফ্রিকা বিষয়ক বিশ্লেষক জিহাদ মাসমাহুনের মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত কেবল আরএসএফ-কে নয়, বরং বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নৃশংস বলপ্রয়োগকারী অন্যান্য মিত্র সুদানি গোষ্ঠীগুলোকেও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা।
তিনি বলেন, “আঞ্চলিক যেসব পক্ষ এই যুদ্ধে মদদ দিচ্ছে, তাদেরও সংঘাত উসকে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।”
সুদানে বর্তমানে লাখ লাখ মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন এবং এই সংঘাত থামার কোনো লক্ষণও নেই। এই পরিস্থিতিতে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, আগামী বছর এই সংকট আরো ঘনীভূত হতে পারে এবং আরো অনেক মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
পরমাণু-শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর যুদ্ধ
২০২৫ সালটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে উত্তেজনার একটি বছর ছিল- থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত সংঘর্ষ থেকে শুরু করে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত সংঘর্ষ, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ এবং পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার চার দিনের সংঘাত পর্যন্ত। এর মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতটিকে দুই পরমাণু-শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে ‘কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সামরিক সংকট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে একটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ৪ দিনের ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের পর যা ছিল দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সামরিক উত্তেজনা।
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির থান্ডারবার্ড স্কুল অব গ্লোবাল ম্যানেজমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক সোফাল ইয়ার এই সবকটি সংঘাতের মধ্যেই একটি সাধারণ ধরন লক্ষ্য করেছেন। তার মতে, নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির অধীনে পুরোনো ফাটলগুলো পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, “দীর্ঘস্থায়ী বিরোধগুলো আরো অস্থির হয়ে উঠছে, কারণ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ এবং আঞ্চলিক বিরোধ-ব্যবস্থাপনা কাঠামোর দুর্বলতা এই উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।” তিনি এই বিষয়ের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, পুরো অঞ্চলটি এখন বিশ্বব্যাপী মেরুকরণ, বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা এবং বহুপাক্ষিক সমাধানের প্রতি আস্থার অভাবের মতো বৈশ্বিক প্রবণতা থেকে মোটেও বিচ্ছিন্ন নয়।
অধ্যাপক সোফাল ২০২৫ সালের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত বিরোধের তীব্রতাকে দেখছেন। এটি দেখায় যে, একটি ‘নিয়ন্ত্রিত’ বিরোধ কত দ্রুত চরম রূপ নিতে পারে।
সব মিলিয়ে ২০২৫ সালটি ছিল এক কথায় ‘অস্থিরতার বছর’। পুরোনো শত্রুতার পুনরুত্থান এবং নতুন ক্ষমতার লড়াই বিশ্বকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সংঘাতময় এমন পরিস্থিতি ২০২৬ সালে আরো নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড