পাঁচ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রবল সংশয়ের মধ্যেই মিয়ানমারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আজ রবিবার থেকে দেশটিতে এই প্রথম নির্বাচন শুরু হলো। খবর রয়টার্সের।
মিয়ানমার শাসনকারী জান্তা সরকার বলছে, এই নির্বাচন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটির জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি নতুন শুরুর সুযোগ।
তবে জাতিসংঘ, কিছু পশ্চিমা দেশ এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীসহ সমালোচকরা এই নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের মতে, জান্তা-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অংশ না নেওয়ায় এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু বা গ্রহণযোগ্য নয়।
২০২০ সালের নির্বাচনে ভূমিধস জয় পাওয়া ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির নেত্রী এবং নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি এখনও বন্দি রয়েছেন। সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েক মাস পর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং তার নেতৃত্বাধীন দলটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
রবিবার (২৮ ডিসেম্বর) স্থানীয় সময় সকাল ৬টায় ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পরপরই ইয়াঙ্গুন এবং মান্দালয়ের মতো বড় শহরগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি দেখা যায়।
জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং বেসামরিক পোশাকে রাজধানী নেপিদোতে ভোট দেন। জান্তা সমর্থিত ‘পপুলার নিউজ জার্নাল’-এ প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, তিনি হাসিমুখে তার কালি মাখানো আঙুল উঁচিয়ে ধরেছেন। উল্লেখ্য, একাধিকবার ভোট দান রোধ করতে ভোটারদের আঙুলে অমোচনীয় কালি ব্যবহার করা হয়।
বিশ্লেষকদের ধারণা অনুযায়ী তিনি নিজেই দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে চান কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জেনারেল বলেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন। তিনি আরও বলেন, "যখন পার্লামেন্টের অধিবেশন বসবে, তখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।"
এগিয়ে আছে সামরিক বাহিনী সমর্থিত দল
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অস্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার। ওই সময় সামরিক বাহিনী নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপরই দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভকারীদের ওপর সেনাবাহিনী নিপীড়ন শুরু করলে অনেক বিক্ষোভকারী অস্ত্র তুলে নেয়, যা পরবর্তীতে জান্তা-বিরোধী এক দেশব্যাপী বিদ্রোহে রূপ নেয়।
থাইল্যান্ডের কাসেতসার্ট ইউনিভার্সিটির মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ ললিতা হানওং-এর মতে, এই নির্বাচনে সামরিক বাহিনী ঘনিষ্ঠ ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)’ পুনরায় ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে। কারণ মোট প্রার্থীদের এক-পঞ্চমাংশই এই দলের এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো শক্তিশালী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
তিনি বলেন, “জান্তার এই নির্বাচন মূলত জনগণের ওপর সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত করার জন্য নকশা করা হয়েছে। ইউএসডিপি এবং সামরিক বাহিনীর মিত্র অন্যান্য দলগুলো একজোট হয়ে পরবর্তী সরকার গঠন করবে।”
রবিবার প্রথম দফার পর ১১ জানুয়ারি এবং ২৫ জানুয়ারি আরো দুই দফায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। মিয়ানমারের ৩৩০টি টাউনশিপের মধ্যে ২৬৫টিতে ভোট হওয়ার কথা রয়েছে, যদিও অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান যুদ্ধের কারণে সব এলাকার ওপর জান্তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে ভোট গণনা বা ফলাফল ঘোষণার তারিখ এখনও জানানো হয়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক গত সপ্তাহে বলেছেন, দেশজুড়ে সংঘাত চলতে থাকায় এই নির্বাচন সহিংসতা ও দমনের পরিবেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বড় শহরগুলোর বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আগের নির্বাচনগুলোর মতো এবার কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। তবে ভোট দেওয়ার জন্য সামরিক প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো জোরজবরদস্তির খবর পাওয়া যায়নি।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, রাশিয়া, চীন, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া এবং ভারত থেকে পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এসেছেন।
রয়টার্সের প্রতিবেদন বলছে, চলমান যুদ্ধের মধ্যে একটি স্থিতিশীল প্রশাসন গঠনের জান্তার এই চেষ্টা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্লেষকদের মতে, বেসামরিক লেবাস পরলেও সামরিক নিয়ন্ত্রিত এই সরকার আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
জান্তার মুখপাত্র জউ মিন তুন স্বীকার করেছেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই এই নির্বাচনের সমালোচনা করবেন। নেপিদোতে ভোট দেওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “তা সত্ত্বেও, এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে। আমরা বিশ্বাস করি একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।”