ক্যাম্পাস

প্রতিবাদ ও প্রশ্নে বিদায়ী বছর

নতুন বছরের কড়া নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে জন্ম নেয় নতুন স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। সময়ের অবিরাম স্রোতে পুরোনো বছর নীরবে বিদায় নেয়, সঙ্গে রেখে যায় প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব, আনন্দ ও বেদনার স্মৃতি। সেই ধারাবাহিকতায় বিদায়ের পথে আরেকটি বছর। সময়ের ঘড়িতে শেষ ঘণ্টা বাজছে, আর পেছনে পড়ে থাকছে ঘটনাবহুল এক অধ্যায়।

বিদায়ী বছরে লালমাটির সবুজ ক্যাম্পাস কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) ছিল নিত্যদিনের ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি আন্দোলন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, বিতর্ক ও স্মৃতিবেদন দিয়ে মুখর। কখনো আশার আলো, কখনো প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত সব মিলিয়ে বছরটি কুবির ইতিহাসে এক বহুমাত্রিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ব্যতিক্রমী পদ্ধতি বছরের শুরুতেই আলোচনায় আসে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা। ১ জানুয়ারি তিনটি বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী ও শূন্যস্থান পূরণ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। অতীতে শিক্ষক নিয়োগে এমন পদ্ধতির নজির না থাকায় ক্যাম্পাসজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকের কাছে এটি স্বচ্ছতা ও মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও স্মৃতির স্বীকৃতি

১৯ জানুয়ারি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত কুবির ৩০ জন শিক্ষার্থীকে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে ১১ জুলাইকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ ঘোষণা করা হয়, যা কুবির আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন প্রতীকী মাত্রা যোগ করে। ওই দিন ‘জুলাই স্মৃতি স্তম্ভ’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনসহ নানা স্মরণানুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

প্রশাসনিক অনিয়ম ও বিতর্ক

বছরের বড় অংশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রশাসনিক বিতর্কে। আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগে রেজিস্ট্রার মো. মজিবুর রহমান মজুমদারকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। পরে নতুন রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।

এর রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয় পোষ্য কোটায় উপাচার্যের মেয়ের ভর্তি নিয়ে তীব্র বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে চলে দীর্ঘ আলোচনা ও সমালোচনা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। আন্দোলন ও মহাসড়ক অবরোধ

১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিতে হামলার প্রতিবাদে কুবি শিক্ষার্থীরা ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে। এতে জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন।

এছাড়া, ২২ আগস্ট চলন্ত বাসে এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করলে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীও ঘটনাস্থলে আসে।

চাকরিচ্যুতি ও সাংগঠনিক উত্তেজনা

৩০ জুন সিন্ডিকেট সভায় দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার অভিযোগে এক শিক্ষক ও এক কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। এ সিদ্ধান্তও আলোচনার জন্ম দেয়।

বছরের শেষ দিকে বিজয় দিবসে পুষ্পস্তবক অর্পণকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ক্যাম্পাসকে উত্তপ্ত করে তোলে। ঘটনাটি প্রশাসনের সামনেই ঘটায় সমালোচনা আরও তীব্র হয়।

শোকের ছায়া

বছরজুড়ে আন্দোলন ও বিতর্কের মাঝেও কুবি হারিয়েছে আপনজন। ১৪ এপ্রিল আইন বিভাগের শিক্ষার্থী তিন্নী আক্তারের মৃত্যু এবং ৮ সেপ্টেম্বর সুমাইয়া আফরিন হত্যাকাণ্ড পুরো ক্যাম্পাসকে শোকাহত করে তোলে। এসব ঘটনা নিরাপত্তা ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকে।

বিদায়ী বছর তাই কুবির ইতিহাসে শুধু একটি সময়কাল নয়; এটি প্রতিবাদ, প্রশ্ন, শোক ও প্রত্যাশার এক সমান্তরাল গল্প। নতুন বছরে সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশাই এখন সবার।