রাইজিংবিডি স্পেশাল

২০২৫ যেন সংস্কারের লড়াই ও অস্থির সময়ের উপাখ্যান 

২০২৫ সাল বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ সময়, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রশাসনিক সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে। এটি এমন এক সময়, যখন সংস্কারের প্রচেষ্টা, পরিবর্তন এবং কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন মিলেমিশে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই বছরটি জাতির ভাগ্যবদলের কাল হওয়ার কথা ছিল, যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, সেই পরিবর্তন কতটা এসেছে, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে চলতেই পেরিয়েছে যাচ্ছে ২০২৫ সাল। 

অপারেশন ডেভিল হান্ট    ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়। তখন সাধারণ মানুষের চোখে দেখা দিয়েছিল এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শুরু হওয়া এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল একটাই—চিহ্নিত সন্ত্রাসী আর পতিত সরকারের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের নির্মূল করা। পাড়ায় পাড়ায় স্বস্তি ফিরবে, এমনটাই ভেবেছিল মানুষ। কিন্তু, বছরের শেষ প্রান্তে এসে দেখা যাচ্ছে, সেই অন্ধকারের শক্তিরা পুরোপুরি দমে যায়নি। অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি আজও থামেনি। তাই বছরটি শেষ হচ্ছে একরাশ অতৃপ্তি নিয়ে। পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়ায় শুরু করতে হয়েছে এই অভিযানের দ্বিতীয় ধাপ বা ‘ফেজ-২’। এটি কেবল একটি অভিযান নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের টিকে থাকার এক মরণপণ লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।

পুলিশে সংস্কার  অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—পুলিশ বাহিনীর প্রতি মানুষের হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। গঠিত হয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। কিন্তু, সেই সংস্কারের চাকা ঘুরছে কচ্ছপ গতিতে। কমিশনের সুপারিশ ছিল আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন আর স্বচ্ছ কাঁচের ইন্টেরোগেশন রুম, যেখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আর কোনো মানুষের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হবে না। কিন্তু, নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, পুরনো থানাগুলোতে এই কক্ষ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। কেবল নতুন ভবনগুলোতে এটি সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। আইন আর কাঠামোগত পরিবর্তনের এই মন্থর গতি সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। তবু, পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ পাসের মাধ্যমে এক চিলতে আলোর দেখা মিলেছে, যদিও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অসন্তোষ সেই আলোয় কিছুটা ছায়া ফেলেছে।

বদলির মহোৎসব ও প্রশাসনিক অস্থিরতা ২০২৫ সালটি ছিল পুলিশ প্রশাসনে এক বিরতিহীন বদলি আর পদোন্নতির বছর। এসপি থেকে ওসি—প্রশাসনের তৃণমূল পর্যন্ত চলেছে রদবদল। নির্বাচনে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এই শুদ্ধি অভিযান জরুরি ছিল ঠিকই, কিন্তু বারবার পরিবর্তনের ফলে অনেক ক্ষেত্রে কাজের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তবু, এক নতুন শুরুর আশায় এই অস্থিরতাকে মেনে নিয়েছে সবাই।

বিদেশের মাটিতে দেশের নতুন মুখ বিপ্লব কেবল দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার ছোঁয়া লেগেছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারেও। প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের আক্ষেপ ছিল যে, বিদেশের মিশনগুলো সাধারণ মানুষের সেবক না হয়ে রাজনৈতিক আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। সেই গ্লানি মুছতে ২০২৫ সালে সরকার এক সাহসী পদক্ষেপ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইতালিসহ বিশ্বের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের ১৫টি মিশনে নিয়োগ দেওয়া হয় নতুন ফার্স্ট সেক্রেটারি। আরো চারটি দেশে সেকেন্ড সেক্রেটারি নিয়োগের মাধ্যমে বৈদেশিক মিশনগুলোতে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা করা হয়েছে। লক্ষ্য ছিল—বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মর্যাদা পুনরুদ্ধার এবং রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রকৃত সম্মান নিশ্চিত করা।

নিরাপত্তার নতুন দেয়াল আনসারের পাঁচটি ব্যাটালিয়ন সামনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গণতন্ত্রের এই মহোৎসবকে ঘিরে মানুষের মনে যেমন আনন্দ আছে, তেমনই আছে এক অদৃশ্য শঙ্কা। সেই শঙ্কা দূর করতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৮ জুলাই এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়। ২ হাজারেরও বেশি সদস্য নিয়ে আনসার বাহিনীর পাঁচটি নতুন ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়। ঢাকা থেকে শুরু করে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সংঘাতময় এলাকা কিংবা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো সংবেদনশীল স্থান সবখানেই এখন এই নতুন ব্যাটালিয়নগুলোর সরব উপস্থিতি। এই জওয়ানদের চোখের মণি যেন পাহারা দিচ্ছে দেশের সার্বভৌমত্ব আর সাধারণ মানুষের ভোটাধিকারকে।

মহাসড়কের কান্না মুছবে কে  প্রতিদিন খবরের কাগজে মহাসড়কে ঝরে পড়া প্রাণের খবর আমাদের হাহাকার বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু, বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতায় অনেক অপরাধীই পার পেয়ে যায়। হাইওয়ে পুলিশ বর্তমানে মামলা করতে পারলেও তদন্তের ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। ফলে, ডায়েরির পাতায় বন্দি হয়ে থাকে বিচারের আকাঙ্ক্ষা। এই অসহায়ত্ব দূর করতে হাইওয়ে পুলিশ এবার সরাসরি তদন্তের ক্ষমতা চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। এটি কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং রাজপথে স্বজন হারানো হাজারো পরিবারের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার এক করুণ আকুতি।

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ছায়া ও রাষ্ট্রের পাহারাদার নির্বাচনের আগে জামিনে মুক্ত হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম শুনলে আজও সাধারণ মানুষের বুকে কাঁপন ধরে। অন্ধকার জগতের এই কারিগররা যেন আবার সমাজকে বিষিয়ে না তোলে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ নিয়েছে এক বজ্রকঠিন সিদ্ধান্ত। এনএসআই, ডিজিএফআই এবং এসবিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখতে। অপরাধের সামান্যতম আভাস পেলেই তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি কেবল নজরদারি নয়, বরং সাধারণ মানুষকে দেওয়া রাষ্ট্রের এক রক্ষাকবচ।

খোদা বকশ চৌধুরীর প্রস্থান: একটি বিদায় ও অন্তিম ভাবনা বছরের শেষভাগে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। আন্দোলনের মুখে অবশেষে ডিসেম্বরের শেষে বিদায় নিতে হয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরীকে। একসময়ের প্রতাপশালী এই কর্মকর্তার নীরব প্রস্থান যেন একটি বার্তারই প্রতিফলন— দায়বদ্ধতা যেখানে নেই, সেখানে স্থায়িত্বও নেই।

স্বরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, একদিকে সংস্কারের অসমাপ্ত কাজ, অন্যদিকে এক নতুন ভোরের প্রতীক্ষা। রক্তস্নাত বিপ্লবের পর এই দেশ যে আইনশৃঙ্খলা আর শান্তির স্বপ্ন দেখেছিল, তার পূর্ণতা হয়ত ২০২৬ সালে আসবে। কিন্তু, ২০২৫ সালটি ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে এক কঠিন সংগ্রামের বছর হিসেবে, যেখানে প্রতিটি পরিবর্তনের পেছনে মিশে ছিল কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর প্রার্থনা।