ক্যাম্পাস

২০২৫ সালে বাকৃবি: অর্জন–অস্থিরতার দ্বৈত বাস্তবতা

২০২৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) একযোগে অর্জন ও অস্থিরতার প্রতীক হয়ে ওঠে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা, নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে, তেমনি বছরজুড়ে আন্দোলন, প্রশাসনিক সংকট, সহিংসতা ও শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে ক্যাম্পাসের স্থিতিশীলতা ও শাসনব্যবস্থা।

একদিকে কৃষক দিবসের মতো ব্যতিক্রমী উদ্যোগ, স্কোপাস ও স্ট্যানফোর্ড–এলসেভিয়ার তালিকায় গবেষকদের সাফল্য, নতুন ইনস্টিটিউট, ভ্যাকসিন, মাছ ও ফসলের জাত উদ্ভাবন; অন্যদিকে হলকেন্দ্রিক সহিংসতা, র‍্যাগিং, নামকরণ বিতর্ক, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, প্রশাসনিক ভবনে তালা, রেললাইন অবরোধ ও বহিরাগত হামলার মতো ঘটনাগুলো ২০২৫ সালকে বাকৃবির ইতিহাসে এক জটিল ও ঘটনাবহুল বছরে পরিণত করেছে।

উদ্ভাবন ও গবেষণায় উজ্জ্বল বাকৃবি

২০২৫ সালে গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বাকৃবি। স্কোপাস র‌্যাংকিংয়ে ১০ গবেষক এবং স্ট্যানফোর্ড–এলসেভিয়ার প্রকাশিত বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ গবেষকের তালিকায় ১২ জন গবেষকের অন্তর্ভুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সক্ষমতার স্বীকৃতি বহন করে।

গবেষণার ক্ষেত্রেও এসেছে একাধিক যুগান্তকারী সাফল্য; সমুদ্রে ভাসমান খাঁচায় কৃত্রিম খাদ্যে ভেটকি চাষ; বিলুপ্তপ্রায় গোটালি মাছের কৃত্রিম প্রজনন; ‘বাউ বিফস্টেক টমেটো-১’ নামের উচ্চ ফলনশীল ও পুষ্টিসমৃদ্ধ টমেটোর জাত; হাঁসের প্লেগ প্রতিরোধে নতুন ভ্যাকসিন; দেশে প্রথমবারের মতো বেশি বিপজ্জনক ২৫টি বালাইনাশক শনাক্ত; ন্যানো বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া উদ্ভাবনের দাবি; এসব গবেষণা দেশের খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব কৃষির নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

আন্দোলন, সংঘর্ষ ও প্রশাসনিক সংকট

তবে গবেষণার সাফল্যের পাশাপাশি ২০২৫ সাল ছিল আন্দোলন ও অস্থিরতায় ভরা। শ্রেণিকক্ষ সংকট, সিট সংকট, র‍্যাগিং, হলের নাম পরিবর্তন, কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবি এবং পেশাগত বৈষম্য নিরসনের দাবিতে একের পর এক আন্দোলনে উত্তাল থাকে ক্যাম্পাস।

বিশেষ করে ভেটেরিনারি ও পশুপালন অনুষদের কম্বাইন্ড ডিগ্রি আন্দোলন পুরো বছরজুড়ে বাকৃবির সবচেয়ে বড় সংকটে রূপ নেয়। প্রশাসনিক ভবনে তালা, উপাচার্যের অবরুদ্ধ হওয়া, রেললাইন অবরোধ, বহিরাগতদের হামলা, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

একাধিক ঘটনায় শিক্ষক–শিক্ষার্থী–কর্মকর্তাসহ মোট ১৫৪ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার প্রশ্ন

২০২৫ সালে বাকৃবি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়েও সমালোচনার মুখে পড়ে। র‍্যাগিংয়ের ঘটনায় নারী–পুরুষ মিলিয়ে একাধিক শিক্ষার্থীর শাস্তি, অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনা, বহিরাগতদের হামলা, নারী শিক্ষার্থীদের গোপন ছবি ধারণের অভিযোগ, নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে প্রেস ক্লাবের অনুমোদন স্থগিত, এসব ঘটনা ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক নজরদারি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।

প্রশাসনিক সংস্কার ও অবকাঠামোগত অগ্রগতি

সংকটের মাঝেও প্রশাসনিক সংস্কার ও অবকাঠামো উন্নয়নের কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের ৩৮৮ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন, দুটি নতুন ইনস্টিটিউটের যাত্রা, নতুন ছাত্রী হল উদ্বোধন, সার্টিফিকেট প্রদানে অটোমেশন সিস্টেম চালু, এসব উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক হলেও সেগুলোর বাস্তব প্রভাব নির্ভর করবে স্থিতিশীল প্রশাসনিক পরিবেশের ওপর।

শেষ থেকে শুরু

সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল বাকৃবির জন্য ছিল সাফল্য ও সংকটের সহাবস্থানের বছর। গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে, তেমনি প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক–সাংগঠনিক সংঘাত তার ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আগামী দিনে বাকৃবির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে—এই দুই বিপরীত বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল ও গবেষণাবান্ধব ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা।