২০২৫ নামিয়ে রাখছে তার দিনলিপি। ক্যালেন্ডারের শেষ পাতায় দাঁড়িয়ে সময় যেন এক মুহূর্ত থমকে আমাদের বলছে- ফিরে তাকাও। স্মৃতির অলিগলিতে হাঁটলে চোখে পড়ে এক বছরের রঙিন-ধূসর সব অধ্যায়; কোথাও উল্লাসের করতালি, কোথাও হতাশার নীরব দীর্ঘশ্বাস, আবার কোথাও ইতিহাস ছুঁয়ে ফেলার সেই ক্ষণিকের কিন্তু অমূল্য মুহূর্ত।
এই সবকিছুর মাঝেই বাংলাদেশের ফুটবল আকাশে হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল এক নতুন নক্ষত্র। নাম তার হামজা দেওয়ান চৌধুরী। লাল-সবুজের জার্সি গায়ে তোলা ছিল শুধু একজন খেলোয়াড়ের অভিষেক নয়, ছিল বহুদিন জমে থাকা স্বপ্নের পুনর্জাগরণ। মাঠে তার পা পড়তেই নড়েচড়ে বসে দেশের প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে পড়া ফুটবল। গ্যালারির নীরবতা ভেঙে ফেরে গর্জন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জন্ম নেয় নতুন আলোড়ন। হারাতে বসা বিশ্বাস ফিরে পায় তার ঠিকানা- একটি নামেই।
যেদিন অফিসিয়াল ঘোষণা আসলো লেস্টার সিটির মিডফিল্ডার হামজা দেওয়ান চৌধুরী এখন থেকে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলে। সেদিন শুধু একজন ফুটবলার যোগ দেননি, সেদিন বদলে যেতে শুরু করে দেশের ফুটবলের ভাগ্যরেখাও।
ভারত: যেখানে শুরু ‘দ্য হামজা ইফেক্ট’ ২৫ মার্চ ২০২৫। শিলং। এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব। সাউথ এশিয়ান ক্লাসিকো দিয়ে লাল-সবুজে অভিষেক হামজার। প্রতিপক্ষ ভারত। যাদের বিপক্ষে বাংলাদেশের হীনমন্যতা ছিল দীর্ঘদিনের। মাঠে নামতেই বোঝা গেল, বাংলাদেশ এখন আর আগের বাংলাদেশ নেই। মিডফিল্ডে একচ্ছত্র আধিপত্য হামজার। বল কন্ট্রোল, ট্যাকল টাইমিং, পজিশনিং; সব মিলিয়ে ভারতের ছন্দ ভেঙে চুরমার। অবসর ভেঙে ফেরা সুনীল ছেত্রীও সেদিন বুঝেছেন, এক জন হামজা কীভাবে পুরো দলকে বদলে দিতে পারে। গোল না হলেও ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ছিল হামজার পায়ে। সেই ম্যাচেই জন্ম নেয় আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের ধারণা।
ভুটান: ঘরের মাঠে নতুন যুগের ঘোষণা জুন উইন্ডো। প্রস্তুতি ম্যাচ। প্রতিপক্ষ ভুটান। ৫৫ মাস পর বাংলাদেশের ঘরের মাঠে আন্তর্জাতিক ফুটবল। গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ। কারণ একটাই- হামজা। সময় নিলেন মাত্র পাঁচ মিনিট। অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার কর্নারে হেড এবং গোল। ঘরের মাঠে অভিষেক রাঙালেন গোল দিয়ে। যেন ঘোষণা দিলেন, এই বাংলাদেশ নতুন বাংলাদেশ। সেই গোলের সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো গ্যালারি, গর্জন পৌঁছে গেল টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, প্রবাসের বাংলাদেশিদের হৃদয়েও।
সিঙ্গাপুর: হারেও জন্ম নেয় বিশ্বাস এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের দ্বিতীয় ম্যাচ। হাইভোল্টেজ উত্তেজনা। প্রতিপক্ষ সিঙ্গাপুর। দুই গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়া ম্যাচে বাংলাদেশ ফিরলো রাকিব হোসেনের গোলে, হামজার নিখুঁত অ্যাসিস্টে। শেষ কটা মিনিটে হামজারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জয় ছিনিয়ে নিতে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিতর্কিত রেফারি সিদ্ধান্ত আর গোলপোস্ট। হার এল, কিন্তু বিশ্বাস জন্ম নিল- এই দল পারে।
হংকং: প্রতিবাদ, প্রতিশোধ আর লড়াই সেপ্টেম্বরে নেপালের বিপক্ষে খেলতে পারেননি হামজা। কিন্তু অক্টোবরে হংকং চায়নার বিপক্ষে হোম-অ্যাওয়ে দুই ম্যাচেই তিনি ছিলেন কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকায় প্রেস কনফারেন্সে প্রতিপক্ষ কোচের তাচ্ছিল্যের জবাব দিলেন মাঠে- ফ্রি কিক থেকে অসাধারণ গোল করে। জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারি ফেটে পড়লো আনন্দে। অ্যাওয়ে লেগে নাটক আরও গভীর। ৩–১ পিছিয়ে পড়া ম্যাচে শমিত সোমের এডেড টাইমের সমতায়ন। মনে হচ্ছিল ইতিহাস লেখা হচ্ছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তের আরেক গোল সব ভেঙে দেয়। মাঠ ছাড়ার সময় হতাশ হামজার কণ্ঠে তখনও দৃঢ়তা- “The team will fight back.”
নেপাল: আগুন ঝরানো প্রত্যাবর্তন নভেম্বরে ভারত ম্যাচের আগে নেপালের বিপক্ষে হামজা যেন নিজের ক্ষোভ উগরে দিলেন। ওভারহেড এক্রোব্যাটিক গোল- স্টেডিয়াম স্তব্ধ। এরপর পেনাল্টিতে পানেনকা শটে গোল। ছয় ম্যাচে তখন তার পরিসংখ্যান- ৪ গোল, ১ অ্যাসিস্ট। কিন্তু সংখ্যার চেয়েও বড় ছিল প্রভাব। মিডফিল্ডের নেতৃত্ব, ডিফেন্সের কভার, আক্রমণের সূচনা; সবখানেই হামজা।
আবার ভারত: ইতিহাস বদলের ম্যাচ ফিরতি লেগে ভারত। এবার আর ভয় নয়। এবার আত্মবিশ্বাস। প্রথম কম্পিটিটিভ ম্যাচেই জয়। গোল ঠেকানো, মিডফিল্ড শাসন, ডিফেন্সিভ লাইন সংগঠিত করা- হামজা ছিলেন সর্বত্র। শমিত-হামজারা বুঝিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ এখন ম্যাচ জিততেও জানে।
মাঠের বাইরেও হামজা বিপ্লব: হামজার প্রভাব কেবল স্কোরলাইনে নয়। বদলে গেছে গোটা ফুটবল কাঠামো। যে ফুটবলে এক সময় স্পন্সর পাওয়া ছিল দুঃস্বপ্ন, সেখানে এখন স্পন্সরের সারি। জার্সি, টিম পার্টনার, ব্র্যান্ড ভ্যালু; সবকিছুই ঊর্ধ্বমুখী। স্টেডিয়ামে দর্শক, টিভিতে রেটিং, সোশ্যাল মিডিয়ায় এনগেজমেন্ট- সব জায়গায় উল্লম্ফন। স্কুল থেকে কলেজ, শহর থেকে গ্রাম, চায়ের টং থেকে অভিজাত রেস্টুরেন্ট; একটাই নাম, হামজা। দেশ-প্রবাস মিলিয়ে কোটি ভক্তের ভালোবাসা।
হামজা দেওয়ান চৌধুরী শুধু একজন ফুটবলার নন। তিনি একটি বিশ্বাসের নাম। নম্রতা, শালীনতা আর মাঠের দৃঢ়তায় তিনি বাংলাদেশকে শিখিয়েছেন মাথা তুলে দাঁড়াতে। যারা বলেছিলেন, “এক হামজা আর কীই বা করবে?” এক বছরেই তার উত্তর লেখা হয়ে গেছে মাঠে, গ্যালারিতে, স্পন্সর বোর্ডে আর কোটি মানুষের হৃদয়ে। বাংলাদেশের ফুটবল বদলে গেছে। এটাই ‘দ্য হামজা ইফেক্ট’।