শাহ মতিন টিপু : রাজনীতি কী না পারে! কেবল রাজনীতির সুবাদে ভারতে রাতরাতি বিখ্যাত শব্দের তালিকায় নাম লেখাল ‘লাভ জিহাদ’। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ভারতের রাজনীতিতে আলোচনায় নিয়ে এল ‘লাভ জিহাদ’। লাভ জিহাদ নিয়ে ছড়ানো হলো প্রচারপত্র। গুজরাটি ভাষায় লেখা প্রচারপত্রে বলা হলো, ‘আপনি কি যৌনকর্মী হতে চান? না? তবে পড়ুন, ভাবুন ও সেভাবে কাজ করুন।’
ভিএইচপি প্রচারপত্রে আরো বলা হলো, হিন্দু মেয়েদের পটিয়ে বিয়ে করার জন্য মুসলিম যুবকদের অর্থ, প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আবার রাজনীতির কারণেই জবাব দিলেন উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির মন্ত্রী আজম খান।
বললেন, ‘লাভ’ ও ‘জিহাদ’ দুটিই পবিত্র শব্দ। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হলে দোষের কিছু নেই। বিজেপির দুই নেতা মুখতার আব্বাস নাকভি ও শাহনেওয়াজ হুসেন হিন্দু নারী বিয়ে করেছেন। তাদের জিজ্ঞেস করুন, লাভ জিহাদের অর্থ কী।
এভাবেই নতুন করে ভারতে লাভ জিহাদ নিয়ে তোলপাড় চলল। অবশ্য, লাভ জিহাদ টার্মটি এসেছে আরো বছর পাঁচেক আগেই। টার্মটির উৎপত্তি ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন থেকেই। আর তাও রাজনীতির জন্যই। থিমও সেই একই। ‘ভারতীয় মুসলমান পুরুষরা হিন্দু নারীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন এবং হিন্দু নারীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম হচ্ছেন। এ উপায়ে ভারতে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।’
প্রশ্ন হলো- কারা লাভ জিহাদের ঘোষণাদাতা? লাভ জিহাদের রাজনীতিকরা এ প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। যদিও জি নিউজসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল, আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিম ও তার সমগোত্রীয় মুসলমান ডনরা লাভ জিহাদে বিনিয়োগ করছেন।
অভিযোগে বলা হয়, এই ডনরা ভারতের বিনোদনজগতে মোটা অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ করে সিনেমা, সিরিয়াল, নাটক প্রযোজনা করাচ্ছেন। এসব গল্পের কেন্দ্রে থাকে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলমান ছেলের প্রেম, বিবাহ এবং উপসংহারে সংসারে উত্তরণ। বিষয়টিকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ‘ছায়াযুদ্ধ’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। যা লাভ জিহাদের রাজনীতিতে বাতাস দেওয়ার মতো অন্তঃসারশূন্য খবর ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যা ক্ষমতায় আসা দেশটির সরকারকে ভাবিয়েছেই শুধু। আগাগোড়া বুঝতে না পেরে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং লাভ জিহাদ সম্পর্কে জানতে চান। সরাসরি নয়াদিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনেই প্রশ্ন তোলেন- ‘লাভ জিহাদ কী? বিষয়টি আমি জানতে চাই।’ অথচ যারা লাভ জিহাদ নিয়ে মাঠ গরম করছেন, তারা তার অথবা তাদেরই রাজনৈতিক মিত্র দলের লোক। বিশুদ্ধ হিন্দুত্ববাদের প্রচারক উত্তর প্রদেশে বিজেপি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য যোগী আদিত্যনাথ। বিজেপি নেতা উশা ঠাকুরও তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘হিন্দুত্ব বাঁচাও’ স্লোগান তোলেন। এই সারিতে আছেন আরো অনেক বেজিপি নেতাও। আর এটাও আরেক রাজনীতি!
আবার শিবসেনা নেতা রাজেশ্বর সিং ঘোষণা দেন, ‘হিন্দু তরঙ্গ সবে শুরু হয়েছে। ১০ বছরের ভারতের সব খ্রিষ্টান ও মুসলমানকে হিন্দুধর্মে আনা হবে।’ আসলে সবই রাজনীতি, সবই বাগাড়ম্বর।৪ সেপ্টেম্বর লখ্নৌ হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য সরকার এবং নির্বাচন কমিশন কথিত ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে বিষয়ে কী ভাবছেন তা জানাতে রুল জারি করেন। এর আগে লাভ জিহাদের ব্যবহার বন্ধ করতে এবং বিজেপির সাংসদ যোগী আদিত্য নাথের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে একটি জনস্বার্থ মামলাও হয় আদালতে।
উত্তর প্রদেশের মিরাটে এই সেপ্টেম্বরে এক হিন্দু যুবতীকে জোর করে ধর্মান্তরিত করে ধর্ষণ করা হয়েছে, এই অভিযোগ ওঠার পর থেকেই লাভ জিহাদ শব্দটি নতুন করে ব্যবহার শুরু করেন বিজেপি ও তাদের ঘনিষ্ঠ হিন্দু সংগঠনের নেতারা। নতুন করে মিডিয়ায়ও ঝড় ওঠে লাভ জিহাদ নিয়ে।
সেই লাভ জিহাদ বিতর্কে চাঞ্চল্যকর মোড় নিয়েছে আবার। মিরাটের যে ২২ বছরের যুবতী তাকে গণধর্ষণ করে ভয় দেখিয়ে ধর্ম বদলাতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনেছিলেন, এখন একেবারেই উল্টো সুর তার গলায়। গণধর্ষণ ও জোর করে ধর্মবদলের অভিযোগ থেকে সরে এসে এখন তার দাবি, তিনি স্বেচ্ছায় এক মুসলিম ছেলের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় তিনি যা বলেছিলেন, সোমবার তার বিপরীত কথা বললেন।
অথচ ওই যুবতীর দায়ের করা আগের অভিযোগকে হাতিয়ার করে উত্তর প্রদেশে সাম্প্রতিক বিধানসভা উপনির্বাচনে ফসল তোলার চেষ্টা করেছিল বিজেপি। কিন্তু আজ তাতে নয়া মাত্রা যোগ হলো যুবতীর বয়ান বদলে যাওয়ায়।
এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) ক্যাপ্টেন এম এস বেগ জানান, সোমবারই ওই যুবতীর বাবা থানায় তার মেয়ে নিখোঁজ বলে ডায়েরি করেন। পুলিশ তার খোঁজ শুরু করে। এ দিন আচমকা যুবতী নিজেই মহিলা থানায় হাজির হন। দাবি করেন, তার বাবা-মায়ের দিক থেকে তিনি প্রাণসংশয়ে ভুগছেন! তিনি নিজে থেকেই মুসলিম যুবকটির সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। তাকে গণধর্ষণ করা হয়নি, ধর্মও বদল হয়নি তার।
তবে মেয়েটির বাবার পাল্টা অভিযোগ, সে সত্য কথা বলতে পারছে না। ভয় দেখানো হয়েছে তাকে। চাপের মুখে সে আগের বক্তব্য অস্বীকার করছে। মেয়েটি পুলিশকে বলেছেন, তার জীবন সংশয় দেখা গিয়েছিল বলেই তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। তাকে মারধর করা হয়েছে বলেও দাবি করেছেন। অথচ মেয়ের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে কলিম নামে একজনসহ আটজনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ।
মেয়েটির নতুন বক্তব্যে আপাতত লাভ জিহাদের গতিপথ বদলে গেলেও রাজনীতিকরা সেটা হতে দেবেন বলে মনে হয় না। কারণ এত সরল সমীকরণে রাজনীতি চলে না। রাজনীতি ভুল পথে হাঁটলে ওটাকেই সঠিক প্রমাণে ইস্পাতসম কঠিন রূপ ধারণ করে। ইতিমধ্যে সে প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। সরব হয়ে উঠেছেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি স্বয়ং।
লাভ জিহাদ তত্ত্ব এত তাড়াতাড়িই থেমে যাওয়ার নয়। কী হয়, পানি কোনদিকে গড়ায়, সেটাই দেখার পালা এখন। তবে এটাই সত্য যে ‘সত্য চিরদিনই প্রতিষ্ঠিত’।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ অক্টোবর ২০১৪/টিপু/কমল কর্মকার