সাতসতেরো

হারিয়ে যাচ্ছে বউ-রানি

আবদুল মান্নান পলাশ, চাটমোহর (পাবনা) : বেশি দিন আগের কথা নয়। চলনবিলে বউ-রানির দেখা মিলত অনেক। এই সেদিনও ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যেত সুন্দরী বউ-রানিদের। এখন শুধুই স্মৃতি।

 

না, এ বউ-রানি, সে বউ-রানি নয়। চলনবিলের মাছের ঐতিহ্যের প্রতীক মৎস্য সুন্দরী ‘বউ-রানি’।

 

বর্ষাকাল আসে-যায়। এখন আর বউ-রানির দেখা মেলে না। তার মানে, বউ-রানি আর নেই। মৎস্যভা-ার খ্যাত চলনবিলের মিষ্টি পানির সুস্বাদু মাছের তালিকা থেকে তার নাম অনেক আগেই উঠে গেছে। বউ-রানি এখন বিলুপ্তপ্রায় মাছের নাম।

 

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক চন্দ্র হলদার জানান, চলনবিলে বউ মাছের দুটি প্রজাতি পাওয়া যায়। যারা দেখতে অনেকটা একই ধরনের হলেও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এদের পৃথক করা যায়। এই দুটি প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম বেটিয়া ডরিও এবং বেটিয়া লোহাচিটা। চলনবিল এলাকায় মাছ দুটি বউ মাছ ও রাণী মাছ নামে সুপরিচিত। তবে দেশের অন্যান্য অনেক স্থানে মাছ দুটি বেটি, পুতুল, বেতাঙ্গী প্রভৃতি নামেও পরিচিত। বউ-রানি দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। চ্যাপ্টা ও লম্বাটে দেহধারী। উভয় প্রজাতির মাছেরই মুখ আকারে ছোট। চার জোড়া ক্ষুদ্রাকৃতির স্পর্শী থাকে।

 

বেটিয়া ডরিও প্রজাতির মাছের দেহের রং হলুদ বা হলুদাভাব। দেহে বেশকিছু (সাধারণত সাতটি) কালচে দাগ। অন্যদিকে বেটিয়া লোহাচিটা প্রজাতির মাছের দেহও হলুদ বা হলদেটে। এদের দেহেও চারটি কালো দাগ থাকে। উভয় প্রজাতির মাছেরই আইশ অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতির। সাধারণ দৃষ্টিতে বোঝাই যায় না। এদের পার্শ্বরেখা সম্পূর্ণ। আকারের দিক থেকে বেটিয়া ডরিও সর্বোচ্চ প্রায় ১৮ সেন্টিমিটার এবং বেটিয়া লোহাচিটা সর্বোচ্চ ১১ সেন্টিমিটার।

 

তিনি আরো জানান, বউ-রানি মাছ প্রায় সব ধরনের মিঠাপানির জলাশয়ের (খাল-বিল, নদী-নালা, হাওড়-বাওড়) তলদেশে পরিস্কার পানিতে বসবাস করতে পছন্দ করে। তবে কখনো কখনোও ঘোলা পানিতেও এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। চলনবিলের প্রায় সবখানে এদের উপস্থিতি একসময় প্রচুর পরিমাণে ছিল। এখন শুধু বর্ষাকালে অতি সামান্য পরিমাণে দেখা মেলে। চলনবিল ছাড়াও রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ফরিদপুর, পার্বত্য চট্টগ্রামের জলাশয়ে, বিশেষ করে নদীতে বউ মাছের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

 

বউ ও রানি মাছ সাধারণত মে থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যবর্তী সময়ে প্রজনন করে থাকে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বাজারে এই মাছের বেশ চাহিদা রয়েছে। প্রায় সব শ্রেণির মানুষ এ মাছ পছন্দ করে। অক্টোবরের শেষ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বর্ষাকালের শেষে যখন বিলের পানি কমে যেতে থাকে তখন এরা জালে বেশি ধরা পড়ে। আর এ সময়েই বাজারে এদের সামান্য উপস্থিতি চোখে পড়ে এখন।

 

মানুষের খাবার তালিকা ছাড়াও এই দুটি মাছের চাহিদা রয়েছে অন্য ক্ষেত্রে। সৌখিন মানুষরা বাসায় শোভা বর্ধনে অ্যাকুরিয়ামে রেখেও পালন করে বউ-রানিদের। আমাদের দেশে সৌখিনভাবে অ্যাকুয়ারিয়ামে এই মাছ পালনের প্রবণতা কম হলেও বিভিন্ন দেশে এরা অ্যাকুয়ারিয়ামের শোভা বাড়াচ্ছে।

 

কারেন্ট জালসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে মাছ আহরণ, ছোট-বড় আকার বিবেচনা না করে মাছ ধরা, রাস্তা-ঘাট, বসতবাড়ি নির্মাণের মাধ্যমে মাছের বাসস্থান ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস, জলাশয় সম্পূর্ণ শুকিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদি কারণে এই মাছের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকরি পদক্ষেপ না নিলে অন্যন্য দেশি মাছের মতো এ মাছও অচিরেই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে।

 

বউ-রানিকে নিয়ে পাবনার চাটমোহর উপজেলার পুরাতন বাজারে কথা হয় হালের ইলিশ ব্যবসায়ী সুশীল হলদারের (৫৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যুবককালে দেকিচি খুব। বাবাও মাছের ব্যবসা কোরতো। ঝাকা বোঝাই নানা পদের মাছ কিনে লিয়ে আসত। তার মধ্যে গাদিগাদি বউ-রানি মাছ। মা খাওয়ার বেছে বেছে বউ-রানি রাখত। আমি বয়েমের মধ্যে গোটা কয়েক পানি দিয়ে রাখতাম। খুব স্বাদের তেলুক মাছ ছিল বউ-রানি। এখন আর চোখে পড়ে না।’

   

রাইজিংবিডি/পাবনা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/পলাশ/রফিক