নিজস্ব প্রতিবেদকরাজবাড়ী, ৪ আগষ্ট: সাংসারিক কাজ ও পড়ালেখার ফাঁকে টুপি সেলাই ও নকশার কাজ করে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে ১০ হাজারের বেশি নারীশিশু ও মহিলা সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন।
তাদের তৈরি ও সেলাই করা টুপি সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আফ্রিকার কয়েকটি মুসলিম দেশে রফতানি হচ্ছে।
এতে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব খাত সমৃদ্ধ হচ্ছে, অপরদিকে গ্রামীণ নারীশিশু ও মহিলারা নিজেদের ধীরে ধীরে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন।
এ কাজের প্রথম সফল উদ্যোক্তা হলেন বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের গাড়াকোলা (গুনপাড়া) গ্রামের হুমায়ন কবির। তাকে অনুসরণ করে তার চাচাতো ভাই মো. জুলফিকার আলী এই কাজকে আরও বিস্তৃত করেছেন।
ঈদ মৌসুমকে কেন্দ্র করে বিদেশের ঈদবাজার ধরতে দুই ভাইয়ের কর্মতৎপরতায় বালিয়াকান্দি উপজেলার ৫০টি গ্রামের নারীদের চলছে এখন ব্যস্ত সময়। হাতে টুপি ও সুট, পাশে কুরুসকাটা, বাহারি সুতা। নানা সুখ-দুঃখের গল্প ও আড্ডার মধ্য দিয়ে চলছে সুনিপুণ কারুকার্য।
শালমারা গ্রামের শাহনাজ পারভীন জানান, আমার স্বামী কৃষিকাজ করেন। অভাব-অনটনে চলছিল সংসার। ২০০৪ সাল থেকে বাড়ির গৃহস্থালির কাজ সেরে অবসরে প্রতিটি হাফদানা টুপি সেলাই করে ৩২০ টাকা ও ফুলদানা টুপি সেলাই করে ৫২৫ টাকা পান।
নারুয়ার লিয়াকত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী সোহাগী জানায়, আমাদের স্কুলের একশ’ জনেরও বেশি ছাত্রী এই টুপি সেলাইয়ের কাজ করে। নিজের হাতখরচ, পড়ালেখার খরচ শেষে সংসারে খরচের জন্য বাবাকে টাকা দিই।
বালিয়াকান্দির এই বিখ্যাত অভিজাত টুপির ডিজাইনার ও রফতানিকারক মো. হুমায়ন কবির জানান, আমি প্রাতিষ্ঠানিক কোনো লেখাপড়া শিখিনি। ভাষা আয়ত্ত করে ১৯৯২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কাজের আশায় ওমান যাই ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে।
দ্রুত শিখতে থাকি টুপি তৈরির যাবতীয় ডিজাইন ও সার্বিক কাজ। আর চিন্তা করতে থাকি, আমার দেশের গ্রামের নারীদের যদি টুপি তৈরিতে মেশিনের পরিবর্তে হাতে সেলাইয়ে প্রশিক্ষণ দিলে তারা সাংসারিক কাজের ফাঁকে এ কাজ করে নিজেদের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণসহ জীবন মানের উন্নতি করতে পারবে।
কারণ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজারে হাতে তৈরি টুপির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আর সরকার এই টুপি থেকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে।
২০০৪ সাল পর্যন্ত কাজ করে কিছু টুপির স্যাম্পল, ইন্ডিয়ান, ইংল্যান্ড ও জাপানের তৈরি টেট্রন কাপড়, সুতা ও সুচ নিয়ে দেশে ফিরে আসি। নিজ গ্রামের ১০-১২ মহিলাকে টুপি তৈরি ও সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রথম কাজ শুরু করি।
সাড়ে চার হাজারের বেশি টুপির ডিজাইনার হুমায়ন কবির আরও জানান, কাপড়, সুতা ও শ্রমিক মজুরি দিয়ে একটি হাফদানা টুপি তৈরিতে ৭৫০ টাকা ও ফুলদানা টুপি তৈরিতে ৫৫০ টাকা খরচ হয়।
টুপি তৈরির কাঁচামাল প্রথমে বিদেশ থেকে নিয়ে এলেও বর্তমানে দেশীয় ভালো কাপড় ও সুতা ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে এনে মানসম্মত উৎপাদন বজায় রাখার চেষ্টা করছি।
তবে কিছু সুতা ভারতের তৈরি হলেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কয়েকটি দেশ থেকে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এত উত্পাদন খরচ বেশি হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রতিটি হাফদানা টুপি ১০-১৫ রিয়ালে এবং ফুলদানা টুপি ৭-১০ রিয়ালে বিক্রি হয়।
বর্তমানে আমাদের তৈরি হাফদানা ও ফুলদানা টুপির বড় ক্রেতা হলো ওমান। তিনি আবুধাবিতে বাংলাদেশের হস্তশিল্পের বিস্তৃতি ঘটাতে বোতাম তৈরির জন্য কাজ শুরু করবেন।
জুলফিকার আলী জানান, আমি ও হুমায়ুন একই সঙ্গে টুপি নিয়ে রাজবাড়ী, বৃহত্তর ফরিদপুর, মাগুড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মেয়েদের টুপি তৈরিতে প্রশিক্ষণ দিই। তবে তিনি এ হস্তশিল্পের উন্নয়ন ও সম্ভাবনার ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
রাইজিংবিডি/এমএস/এলএ