মতামত

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কিসের ইঙ্গিত বহন করে?

মাছুম বিল্লাহ : ১৯৯২ সালে ভারতে কট্টরপন্থী হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির নির্মাণ করার জন্য মসজিদে হামলা করেছিলো। ঐ ঘটনার জের ধরে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু তৎকালীন এরশাদ সরকার দৃঢ়ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

 

আমি সে সময় টাঙ্গাইলে একটি কলেজে শিক্ষকতা করতাম। আমার কলেজের কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী ছাত্র আমাকে ক্লাসে বলল, ‘স্যার আমাদের বাবরি মসজিদে হিন্দুরা হামলা করেছে। আমাদের ক্লাসে যে ক’জন হিন্দু ছাত্র আছে আমরা ওদের মাইর শুরু করি।’

 

আমি বই বন্ধ রেখে বললাম, ‘কেন? ওরা কি করেছে? ওরা তো ভাঙেনি।’ তারা বলল, ‘স্যার ওরা তো হিন্দু। ওদের তো সমর্থন আছে বিষয়টিতে।’

 

আমি তখন বললাম, ‘তোমরা একটু ঠা-া মাথায় চিন্তা করে দেখ, তোমরা যদি ওদের অবস্থানে থাকতে এবং তোমাদেরকে ওরা বা অন্য কেউ এই কথা বলতো তাহলে তোমাদের কেমন লাগত? ওরাও মানুষ, ওরাও এ দেশের নাগরিক। ওদের যে অনুভুতি, ব্যথা বেদনা, হাসি কান্না আছে, তোমাদেরও তাই আছে। ওদেরও মন আছে, স্বপ্ন আছে, স্বাদ আছে। সব কিছুই এক। ওরাও তোমাদের মতো ছাত্র। তাহলে ওদের কেন মারবে?’

 

ওরা বলল, ‘স্যার ওরা তো হিন্দু, ওরা তো দেব-দেবীর পূজা করে।’ আমি বললাম, ‘দেবদেবীর পূজা করলেই তাদের মারতে হবে? আমরা মসজিদে যাই। আমাদের সংখ্যা যদি ওদের চেয়ে অনেক কম হতো, তাহলে ওদের কাছে আমাদের মসজিদে যাওয়া, জোরে জোরে মাইকে আজান দেওয়া নিশ্চয়ই ভাল লাগত না। ওরা তোমাদের বলতো ওরা মসজিদে যায়, কাজেই ওদের মাইর শুরু করি। বিষয়টি তোমাদের কাছে কেমন লাগত? আসলে তুমি ও আমি এমন ঘরে জন্মগ্রহণ করেছি যেখানে আমরা দেখেছি পরিবারের লোকজন নামাজ পড়ে, মসজিদে যায়। ওরা যে ঘরে জন্ম নিয়েছে সেখানে ওরা দেখতে পেয়েছে ঘরে প্রতিমা আছে, পরিবারের সদস্যরা অন্য এক ধরনের প্রার্থণা করে, মন্দিরে যায়। ওরা মনে করে ¯্রষ্টাকে খুশী রাখার জন্য ওভাবেই প্রার্থণা করতে হবে।’

 

আমরা মনে করি, মসজিদে গেলে নামাজ পড়লে ¯্রষ্টা খুশী হবেন তাই আমরা মসজিদে যাই, নামাজ পড়ি। যারা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী তারা মনে করেন, গির্জায় গেলে ¯্রষ্টা খুশী হবেন। তারা তাই করেন। সবচেয়ে বড় কথা, যে শিশুটি ছোট থেকে তার পরিবারে ও চারদিকে যে কালচার দেখে, সে সেই কালচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তার প্রতি এক ধরনের আলাদা আকর্ষণ ও ভালবাসা জন্মায়। তার অর্থ এই নয় যে, আমার পাশে যারা ¯্রষ্টাকে খুশী করার জন্য অন্যকিছু করে বা করছে তারা আমাদের শত্রু। আমাদের শক্তি ও সামর্থ্য থাকলে তাদের আক্রমণ করতে হবে, মারতে হবে।

 

এই পৃথিবীর সবাই নামাজ পড়ে না, সবাই পূজা করে না, সবাই গির্জায় যায় না, কিন্তু সবাই মানুষ। সবাই একই সূর্যের তাপ ভোগ করে, সবাই অক্সিজেন গ্রহণ করে, কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। সবাই একইভাবে জন্ম নেয়, সবাই মারা যায়।

 

মনে পড়ে, ঐদিন ক্লাসে ইংরেজি না পড়িয়ে পুরো ক্লাসই নিতে হয়েছিল এই দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ইত্যাদি নিয়ে। ছেলে মেয়েরা ঐদিন আমার ঐ ক্লাসেই যেন বেশি আনন্দ পেয়েছিল। বোধ হয় বেশ কাজও হয়েছিল। পরে তাদের মধ্যে আর মারমুখী ভাব দেখতে পাইনি। চাকরি ছেড়ে আসার পর ঐসব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনেকদিন পর্যন্ত চিঠিপত্রও পেতাম, এমনকি এখনও কেউ কেউ ফেসবুক বা অন্যান্য মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ রাখছে।

 

সাম্প্রদায়িকতা কথাটি আমাদের দেশে ধর্মীয় ব্যাপারেই বেশি ব্যবহৃত হচেছ। আসলে এর ব্যাখ্যা বেশ বড়। কোন এক জায়গায় যদি চারজন মানুষও একত্রিত হয়, তাহলেও দেখা যাবে তাদের মধ্যে দুটি কিংবা তিনটি গ্রুপ বা সম্প্রদায়। প্রথমে দেখা যাবে সাধারন কিছু বৈশিষ্ট্য ছাড়া সবারই আলাদা আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার কারণে তারা চারজন চার রকমের। এরপর দেখা যাবে দ্’ুজনের মধ্যে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য যা তাদেরকে বাকী দুজন থেকে আলাদা করেছে। আবার তিনজনের মধ্যে কিছু সাধারন বৈশিষ্ট্য তিনজনকে এক গ্রুপে ফেলেছে, আর একজন একেবারেই একা। এরকম সবাই কোন গুণ, বৈশিষ্ট্য, সামাজিকতা বা বিশ্বাসের কারণে কোন না কোন সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এক ধরনের মিল-অমিল, আচার-আচরণ ও স্বার্থ তাদের একজনকে অন্যের থেকে একটু আলাদা করে রাখে। একইভাবে একটি এলাকায় মানুষ কয়েক ভাগে বিভক্ত।

 

ধরুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন তাদের মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের একটি গ্রুপ, ঢাকার আশপাশ এলাকার একটি গ্রুপ, উত্তরবঙ্গের একটি গ্রুপ। আবার যারা সরকারে থাকা দল করে তাদের একটি গ্রুপ, যারা সরকারের বিরোধীতা করে তাদের একটি গ্রুপ। বামপন্থী রাজনীতির একটি গ্রুপ। সব গ্রুপই তাদের নিজেদের মধ্যে একটি সমঝোতা গড়ে তোলে, ফলে তারা অন্যদের থেকে কিছু দিক দিয়ে কিছুটা আলাদা থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষ ও সাদা মানুষের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব যা আর এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করেছে। এটি পৃথিবীর বাস্তবতা।

 

সত্য, সুন্দর, আদর্শ ও মানবতার কথা হলো মানব সমাজের মধ্যে বিরাজমান বৈশিষ্ট্য স্বীকার করে নিয়ে রাষ্ট্রে বাস করতে হবে মিলেমিশে, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ রক্ষা করে। এখানেই মানুষ ও পশুর মধ্যে তফাৎ। সমস্যা হলো, আমরা এই শিক্ষা কোথাও পাই না, কোন আদর্শ নেই যা আমরা অনুসরণ করবো। না পাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, না পাই সমাজে, না পাই রাষ্ট্রে। কারণ, সবকিছুই নিয়ন্ত্রন করে পেশিশক্তি, দুষ্ট রাজনীতি ও অসততা।

 

বাংলাদেশে যারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা ভিন্নমতের তারা এক ধরনের নিরাপত্তহীনতায় ভোগে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যারা থাকে। একইভাবে ভারতে এবং অন্যান্য দেশে যারা সংখ্যায় একটু কম তারাই নিরাপত্তহীনতায় ভোগে। একেক সময় মনে হয় সুন্দরবনের হরিণগুলো যেমন বাঘের ভয়ে থাকে ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম। আসলে মানবসমাজে তাই কি হওয়া উচিত? তাহলে আমরা মানুষ কেন? আমরা নিজেদের শিক্ষিত বলি কেন? শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষা আমাদের কোথা থেকে অর্জন করতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কি হচেছ সেখানে? শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দলাদলি, হাতাহাতি, মারামারি এবং সাময়িক স্বার্থের জন্য তারা কি না করছে !

 

রাজনীতি যাকে ‘নীতির রাজা’ বলা হয় সেখানে কি হচ্ছে? নাসিরনগরে যে হামলা হলো, কেউই ধরতে পারছে না কে করেছে, কেন করেছে? রাষ্ট্রের জন্য, প্রশাসনের জন্য এটা কি অসম্ভব? এখানে কেউ যদি বলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বিএনপি এই কাজ করেছে, তা অনেকের কাছে খুবই সহজ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে। আবার কেউ যদি বলে যে, সরকার বিএনপিকে আরও ঘায়েল করার জন্য এ কাজ করিয়েছে। তাও বিশ্বাসযোগ্য কারণ, এখানে সততার কোন উদাহরণ আমরা কোথাও পাই না। কাঁদা ছোড়াছুড়ি সবাই করে থাকে শুধু স্বার্থের জন্য। কিন্তু মানুষের এই স্বার্থ কদিন থাকে? নির্দিষ্ট সময় পর সবাইকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়, সেকথা আমরা ভুলে যাই।

 

৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দিরে ভাংচুর, বসতবাড়িতে হামলা ও লুটপাটের পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ, সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন হচ্ছিলো। ওই এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিলো। এরই মধ্যে আবার ৩ নভেম্বর রাতে একই এলাকায় বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। এতে পশ্চিমপাড়ায় অন্তত পাঁচটি ঘর পুড়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি মন্দির। অনেক নারীকে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে রাতের আধারে অন্যত্র পালাতে হয়েছে। নিজ দেশে, নিজ ভিটেমাটিতে এ কেমন বর্বরতা?

 

সংখ্যায় যারা কম তারা নিরাপদে নিজ বাসভূমে বাঁচতে পারছে না। প্রথম দিনের হামলার পর ওই এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল। কিন্ত তারই মধ্যে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল। একে আমরা রাজনীতি ছাড়া আর কি বলতে পারি? আমরা কি একবারও চিন্তা করে দেখেছি যে, এই রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ?

 

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত। ই-মেইল: masumbillah65@gmail.com

 

(মতামত লেখকের নিজস্ব)।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/শাহনেওয়াজ