মতামত

সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার ভাবো তুমি

রুহুল আমিন : একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের মফস্বল ডেস্কে কাজ করি। প্রতিদিন অসংখ্য মৃত্যুর সংবাদ লিখি কিবোর্ড চেপে। স্বাভাবিক মৃত্যু, অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ বিভিন্ন ধরনের মৃত্যুর সংবাদ লিখি।

 

আমার মফস্বল ডেস্কের সাংবাদিকতার জীবনে এমন একটা দিন স্মরনাতীত, যেদিন আমি একটিও মৃত্যুর সংবাদ লিখিনি। এক সময় আমি খুব সংবেদনশীল ছিলাম। প্রথম প্রথম এ ধরনের সংবাদ কিছুটা হলেও আমার ওপর প্রভাব ফেলত। পেটের দায় আর অন্য চাকরি করার নিজের অক্ষমতা বা অনীহার কাছে হার মেনে এখানেই পড়ে আছি অসংখ্য মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে।

 

এটাও ঠিক যে, মৃত্যুর খবর লিখতে এখন আর আগের মতো ভাবিত হই না। নিজের ওপর তেমন একটা প্রভাব পড়ে না। বলা যায়, ধীরে ধীরে, মৃত্যুর সংবাদ লিখতে লিখতে অনুভূতি শক্তি ভোতা হয়ে গেছে।

 

অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে স্বেচ্ছামৃত্যু (আত্মহত্যা) আমাকে খুব তাড়িত করে; ভাবায়। আমার পরিচিত দুই অগ্রজ কবি ছিলেন যারা একে অপরের বন্ধু। ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল না তাদের সঙ্গে আমার। তবে তাদের চিনতাম। তাদের মধ্যে একজন আগে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিলেন। অপরজন তা নিয়ে বেশ কয়েকদিন লেখালেখি করলেন। এমনকি স্বেচ্ছামৃত্যুর বিরুদ্ধে অনেক কিছু করার চেষ্টাও করেছিলেন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এক বন্ধুর স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে অনেক ‍কিছু করতে চাওয়া সেই বন্ধুটিও এক বছর পর স্বেচ্ছামৃত্যুর পথই বেছে নেন। তারপর থেকে স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে আমি তেমন একটা ভাবতে চাই না। কেন জানি মনে হয় স্বেচ্ছামৃত্যু একটা মানসিক রোগ। সুতরাং স্বেচ্ছামৃত্যুর খবর দেখলে এখন আর তেমন ভাবি না।

 

অসংখ্য কারণে আমাদের দেশের মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেয়। এমনকি হাস্যকর কিছু কারণেও দেখেছি অনেক সময় কেউ কেউ স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছে। তখন ভাবনারও বাইরে চলে যায় বিষয়টি। এ ছাড়া প্রেম, হতাশা, স্বাস্থ্যহানি. ঋণে জর্জরিতসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেয়। সব কিছু মিলিয়ে স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণকারীদের ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। এমনকি শোক প্রকাশ করতেও ইচ্ছা করে না।  

 

কিছু ব্যাপার থাকে যা ইচ্ছা না করলেও মনে চলে আসে। এমন কিছু ঘটনা থাকে যা ভাবাতে এক প্রকার বাধ্য করে। তেমনি একটি ঘটনা ঘটে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ শাহপুরে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া উম্মে মারিয়া সম্পা (১৪) ও তামিমা খাতুন বর্ণা নামের দুই বান্ধবী এক সঙ্গে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে। মৃত্যুর আগে দুই জনই কিছু একটা লিখে গেছেন খাতায় (আমি একে সুইসাইড নোট বলতে রাজি নই)। সেখানে দুটি ছেলের নামও পাওয়া গেছে। পরে জানা যায় এক বান্ধবীর প্রেমিক অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে নতুন করে প্রেমে জড়ানোয় স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে সে। অন্যজন উত্ত্যক্তকারীর নাম লিখে গেছে। যে তাকে বিভিন্ন সময় বন্ধুদের নিয়ে উত্ত্যক্ত করত, প্রেমের প্রস্তাব দিত। এই কারণে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে সে।

 

আমার বার বার মনে হয়েছে এই বাচ্চা দুটি মেয়ে কি করে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিল! এতো অল্প বয়সে ঠুনকো কিছু  কারণে কেন মনে হলো স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়া দরকার। প্রেম? উত্ত্যক্ত? শুধু কি তাই? প্রতিটি স্বেচ্ছামৃত্যুর পেছনে সুক্ষ্ম কিছু কারণ থাকে। বলা যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ থাকে। কখনো কখনো প্রত্যক্ষ কারণের চেয়ে পরোক্ষ কারণ বেশি প্রভাব বিস্তার করে। স্বেচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রেও আমার কাছে মনে হয় পরোক্ষ কারণ বেশি কাজ করে।

 

আমরা আসলে এখনো ঠিক বুঝে উঠিনি কীভাবে আমাদের নিজেদের রক্ষার কবচটা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দিয়ে যাবো। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শেখানো হয় না শত আঘাতে কী করে বেঁচে থাকার মন্ত্রে মুগ্ধ হতে হয়। ভেঙে পড়লে উঠে দাঁড়াতে কী করে। স্কুলের ব্যাগ ভারি করে ফেলেছি কিন্তু সেখানে জীবনের নিরাপত্তা, মানুষ হওয়ার মন্ত্র লেখা একটা বইও নেই। শুধু আছে পড়া মুখস্ত করে বড় চাকরি করা। তথাকথিত বড় হওয়ার মন্ত্র। সুস্থ মানসিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে আমরা শিশুদের শিখায় হিংসা বিদ্বেষে পৃথিবী জয়ের মন্ত্র।

 

গ্রাম শহর নগর কোথাও নেই সেই বিকাশের সুযোগ। কারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় যে এই পথের কোনো সন্ধান নেই। তাই পরিপক্ক মানুষ হয়ে ওঠার আগেই সম্পা, বর্ণারা স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো পথ বেছে নিচ্ছে। কারণ তারা বেঁচে থাকার ভিন্ন কোনো গল্পের কথা জানে না। শুধু শিক্ষা ব্যবস্থা না, দেশের পুরো পদ্ধতির কোথাও নেই সেই আশ্রয়ের জায়গা। গল্প কবিতা, উপন্যাস, সিনেমা, নাটক কোথাও নেই। আক্ষেপ একটাই সে সময়টা কবে আসবে এই জাতির জীবনে। যেদিন প্রাথমিক স্কুলে এ ফর আপেলের পরিবর্তে শেখানো হবে পৃথিবী সুন্দর এবং সেখানে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা আরো সুন্দর। সত্য, সুন্দর ও বিশুদ্ধতায় বেঁচে থাকার মন্ত্র শেখাবে। শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি অভিভাবকদেরও হতে হবে সন্তানদের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী।

 

সাম্প্রতিক সময়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী হলো প্রেম। প্রাণির মধ্যে মানুষ সর্বাপেক্ষা আবেগী। আর প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কিংবা প্রেমিকার কাছে প্রতারিত হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণি বেছে নেয় কি না তার খবর এই পর্যন্ত শুনিনি। কিন্তু মানুষ প্রাণির মধ্যে তা ঘটে অহরহ। কিন্তু প্রেমে ব্যর্থ বা প্রতারিত হলে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিতে হবে কেন? প্রেমে পরাতো স্বাভাবিক ঘটনা। প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমিকের বনিবনা না হওয়াটাও তেমনি স্বাভাবিক ব্যাপার। সব সময় মনে রাখতে হবে জীবনের চেয়ে বড় কোনো সম্পর্ক পৃথিবীতে নেই। বিয়ে করার পর, এক দুই যুগ কাটিয়ে দিয়েও তো সংসার ভেঙে যায়। সুতরাং প্রেমতো সেখানে অস্বীকৃত আবেগের বন্ধনী মাত্র। তা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। তাই বলে স্বেচ্ছামৃত্যু কেন? আর সব মানুষ তো প্রেমের মূল্যও বোঝে না। তাই প্রেমঘটিত বোকামি ও হাস্যকর কারণে জীবননাশী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাবতে হবে।

 

স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ও মেয়ে, ও ছেলে তুমি, তোমরা একবার ভাবো- যে তোমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে সে আজ প্রতারণা করেছে। আগামীকালও প্রতারণাই করতো। আজ যাকে পাওনি সে হয়তো কোনোদিনই তোমার ছিল না। মাঝ খানের সময়টুকু শুধু আবেগের খেলা। কিন্তু তোমার জীবনের সঙ্গে আর যারা জড়িত তাদের কথা একবার ভাবো। তারা তোমার জন্য কত কি-ই না করেছে। করবে। একবার ভাবো তাদের কথা যারা তোমাকে কথা বলা শিখিয়েছে, হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে। রোজ রুটিন করে তোমার পেছনে লেগেছিল তোমাকে বড় করতে। তাদের কথা ভাবো যারা তোমাকে হারালে অসহায় হয়ে পড়বে। তুমি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার ভাবো। যারা তোমাকে ছাড়া ভিষণ শূন্যতায় ডুবে যাবে।

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ নভেম্বর ২০১৬/রুহুল/তারা