মতামত

নাসিক নির্বাচনে কে পরবে জয়ের মালা?

সাইফুল ইসলাম : দলীয় মনোনয়ন, মনোয়নপত্র জমা, যাচাই-বাছাই, প্রতীক বিতরণ শেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এখন মাঠে গড়িয়েছে। প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভোট প্রার্থনা করছেন। আগামী ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জবাসী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নতুন মেয়র বেছে নেবেন।

 

উন্নত দেশগুলোর মতো জরিপের চল নেই আমাদের দেশে। থাকলে হয়তো মার্কিন নির্বাচনের মতোই নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন-নাসিক নির্বাচন নিয়েও প্রতিদিন জরিপ হতো। সকাল-বিকাল ফল পাওয়া যেতো। প্রতিদিন দেখা যেতো বিভিন্ন প্রার্থীর জনপ্রিয়তার ওঠা-নামা। আর তা নিয়ে উত্তেজনায় মেতে থাকতো সবাই। আগ্রহীরা তর্ক-বিতর্কে মাতিয়ে রাখতো চায়ের দোকান, ক্লাবের আড্ডা। কারণ নাসিক নির্বাচন ইতিমধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের মাত্রা পেয়েছে।

 

বিএনপি এ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে নতুন করে মাঠে নামার চেষ্টা করছে। তারা মনে করছে, এ নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারলে তার ধাক্কা গিয়ে লাগবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ফিরে আসাটাও সহজ হবে রাজনীতির মাঠে। সরকারি দল আওয়ামী লীগও এ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছে। তারাও চাইছে মেয়রের পদটি যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে। এ কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও এই নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা গেছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও বৈঠক করছেন ২০ দলীয় জোটের নেতাদের নিয়ে। তাই নির্বাচনটি এখন আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আটকে নেই।

 

আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক জরিপের চল না থাকলেও জরিপ চলে জনান্তিকে। ভোটাররা বিভিন্ন চায়ের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁয় প্রার্থীদের সাংগঠনিক দক্ষতা,  চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে করছেন চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশ্লেষণে উঠে আসছে প্রার্থীর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক সব ধরণের আলোচনা।

 

নাসিক নির্বাচনে মোট সাত জন প্রার্থী থাকলেও ইতিমধ্যেই দুই জন প্রার্থীকেই জনগণ আমলে নিয়েছেন। তারা হলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের  সেলিনা হায়াত আইভি এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সাখাওয়াত হোসেন খান। স্ব স্ব প্রার্থীর পক্ষে সমর্থকরা যুক্তি তুলে ধরছেন, বিরোধী পক্ষের অভিযোগকে নানা যুক্তি দেখি খণ্ডনও করছেন তারা। আইভির বিপক্ষে যে সব প্রচার প্রচারণা চলছে তার মধ্যে প্রধান হলো, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে বিভক্তি। বিপক্ষরা বলছেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যত চেষ্টাই করুন না কেন, আইভি আর শামীম ওসমান পরিবারের মধ্যে কোনো সময়েই ঐক্য হবে না। এ বিরোধ তাদের বাবার আমলের। দলের কারণে, নেত্রীর প্রস্তাবে শামীম ওসমান হয়তো বিরোধীতা করবেন না। কিন্তু কখনোই তিনি আইভির পক্ষে ভোটও চাইবেন না, মাঠে নামবেন না। আরো একটি কথা প্রচার আছে যে, গত নির্বাচনে আইভি বিএনপি-জামায়াতের ভোটে জিতেছিলেন। এবার বিএনপির নিজস্ব প্রার্থী থাকায় সে ভোট তিনি আর পাবেন না। তৃতীয়ত, নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে আইভি একটি দল নিরপেক্ষ নিজস্ব ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ায় তার সেই ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে, এ কারণেও তার ভোট কমে যাবে।

 

বিপরীতে আইভি সমর্থকরা বলছেন, শামীম ওসমান আইভির পক্ষে ভোট না চাইলেও বিরোধীতা করার সুযোগ নেই। তাই আওয়ামী লীগের ভোট বিভক্তিরও কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগের পুরো ভোট আইভি পাবেন বলে তার সমর্থকরা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। আইভির পরিবার মানে আওয়ামী লীগ পরিবার। তাছাড়া তার বিপরীতে আওয়ামী লীগ কোনো সমর্থকও নির্বাচন করছেন না। তাই আওয়ামী লীগের ভোট বিভক্ত হয়ে কোথায় যাবে- এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন তারা। এর বাইরে বিএনপির কথিত ভোট ব্যাংকের কথাও তারা ভাবছেন। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণে তাদের ভোট ব্যাংকও এখন ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

এদিকে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের সমর্থকেরাও আটঘাট বেঁধে প্রার্থীর পক্ষে নেমেছেন। তারা মনে করেন, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করতে পারলে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের জাতীয় রাজনীতিতে ফিরে আসা সহজ হবে। তাই ২০ দলীয় জোটের কর্মীরা বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। কেন্দ্রও বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলকেই তারা তাদের ভোট ব্যাংক মনে করছে, তাই তারাও আছে ফুরফুরে মেজাজে। বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের ব্যক্তি সমালোচনা না থাকায় তার সমর্থকেরা তার বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।

 

তবে সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা রাজনৈতিক। কয়েক বছরের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে জনগণের মুখোমখি দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছে। আর ২০ দলে চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী থাকায় এ জোটকে পক্ষান্তরে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবেই চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে।  নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে। তা ছাড়া নারায়ণগঞ্জ বিএনপির প্রধানতম নেতা নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় হোঁচট খেয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ মনে করছেন সাখাওয়াত সাহেব নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারবেন না হয়তো।

 

তবে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ ভোটার তাদের ‘ভোট নষ্ট’ করতে চান না। তাই তারা কাকে ভোট দেবেন এ সিদ্ধান্ত নেন নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক-দুইদিন আগে। কখনো কখনো নির্বাচনের আগের রাতে বা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে। তাই ডাক্তার সেলিনা হায়াত আইভি না সাখাওয়াত হোসেন নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে কে  জিতবেন তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বলা চলে যে, এ দু’জনের মধ্যে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা