মতামত

ভুলে যেতে চাই ২০১৬

ইয়াসিন হাসান : আমার ছোট ভাই তাহসিন হাসান সিয়াম। বয়স আর কতই হবে; ১৯৯৮ সালে জন্ম। খুব আদরে বড় হয়েছে। আমি আর আমার বড় বোন বাবা-মার মার খেলেও ছোট ভাইয়ের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ছোটরা সবচেয়ে আদরের হয় বলে হয়ত এমন হয়েছে।

 

সেই ছোট ভাই আজ অনেকটাই বড়। অনেকটাই পরিণত। ভালো-খারাপ বুঝতে শিখেছে। জীবন সম্পর্কে জ্ঞান পেয়েছে। পড়াশোনায় আহামরি ভালো না হলেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই করছে। তবে খেলাধুলায় খুব মনোযোগ।  আমি ক্রিকেটের যতটা ভক্ত, তাহসিন ফুটবলে ততটাই।

 

তো সেদিন ও ফোনে বাবাকে বলল, বনানিতে একটা খেলা আছে। খেলতে যাব?

শুক্রবার, রোজার মাস। বাবা জানতে চাইল কখন খেলা?

ও বলল, রাতে

বাবা মানা করে দিলেন। আমাদের পরিবারের একটা নিয়ম আছে। যত কিছুই করো না কেন সন্ধ্যায় তোমাকে আপন নীড়ে ফিরতেই হবে।

 

বাবার অনুমতি না পাওয়ায় তাহসিনের স্কুলের এক বড় ভাই আবারও ফোন দিল, আঙ্কেল তাহসিনকে একটু দেন। আমাদের আজ টুর্নামেন্টের বড় খেলা।

 

বাবা আবারও মানা করে দিল। ক্ষোভে ইফতারের পর আমার ছোট ভাইয়ের মুখ কালো। ইফতারের পর আমি কোথাও বেরিয়েছি। বাসায় বউ নেই। আমার বউ না থাকলে আবার আমাদের রুম ছোট ভাই দখল করে নেয়। রাত পৌনে নয়টায় কিংবা নয়টায় বাসায় ফিরলাম। দেখলাম ল্যাপটপে ছোট ভাই ফেসবুক চালাচ্ছে। 

ও আমাকে বলল, খবর দেখছ?

আমি জিজ্ঞেস করলাম কিসের খবর?

ও বলল, গুলশানে গোলাগুলি হইছে।

কখন?

এইতো একটু আগে।

 

টিভি ছাড়লাম। সময় টিভির স্ক্রল দেখে মাথা ঘুরে গেল। অসম্ভব এক ভয়ানক কাণ্ড! জঙ্গি হামলা! হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা! চ্যানেল ঘুরালাম। যমুনা, মাছরাঙা সব জায়গাতেই একই স্ক্রল। ৭১ আবার একটু বেশি এগিয়ে ছিল। সরাসরি গুলশান থেকেই লাইভ করছিল। কিছু বোঝার উপায় নেই কী হচ্ছিল!

 

বাবার একটি ফোন পেলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কই?

বললাম, বাসায়।

তাহসিন কই?

বললাম, আমার পাশে।

আমাকে বললেন, ফোন নিয়ে একটু অন্য রুমে যাও।

আমি কিছু বুঝলাম না। বাবার কথার সুর কেন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছিল।

আমি বললাম কী হয়েছে?

বাবা বললেন, ও আজকে গুলশান না বনানী খেলতে যেতে চেয়েছিল। আমি মানা করার পর এক বড় ভাইও ফোন দিয়েছিল। ওকে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করো যে, খেলতেই যেত না অন্য কোথাও…

 

আমি কিছু বললাম না ওকে। রাত দশটার দিকে দেখলাম ওকে হাসতে। তখন জিজ্ঞেস করলাম। কী হয়েছে? ও বলল, আজকে ম্যাচটা হয় নাই। কিছুদিন পর হবে। আমি খেলতে পারব।

আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, শুধু কী খেলতেই যাওয়ার কথা ছিল আজ?

ও বলল, হ্যাঁ। কেন?

না গুলশানে হামলা হলো তুই আবার….

আরে না কী কও এগুলো!

সত্যি তো???

ও বলল, হ্যাঁ।

 

বাবার সন্দেহ হওয়ার পেছনের কারণগুলো তৈরি হয়েছে এভাবে, তাহসিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করার চেষ্টা করে, ঠান্ডা থাকে, কথা কম বলে আবার ছোটকাল থেকেই সবগুলো রোজা রাখে। সব মিলিয়ে একটু-আধটু সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর কথা, ওর আস্থা সবকিছুই আমাদের সন্দেহের বিপরীতে গিয়েছে। শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেই কাউকে জঙ্গি ভাবা উচিত নয়।

 

২০১৬ সাল, ১ জুলাই। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি দুঃস্বপ্নের রাত। আমি কেন প্রতিটি বাঙালি সুর মেলাবে, একটি ঘটনা দেশের পতাকায় কালিমা লেপন করে দিয়েছে! কিন্তু বাংলাদেশটা কী এমন? অবশ্যই না। বিদেশী দলগুলো যখন আমাদের এখানে খেলতে আসে তখন তারা বলে, ‘বাঙালির আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ।’

 

শুধু কি খেলোয়াড়রা, বিদেশী অতিথি এলে সব সময় বাংলাদেশের প্রেমে পড়েন। পুনরায় ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু একটি ঘটনা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। অন্তত এ ঘটনা বিদেশীদের দেশে আসতে, অর্থ বিনিয়োগ করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। সত্যি বলতে, দেশের ভাবমূর্তি অনেকটাই কমিয়েছে। কিন্তু আমরা আবারও উঠে দাঁড়িয়েছি! 

 

আমরা হচ্ছি সেই জাতি যাদের জন্ম রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা, দারিদ্র, নিপীড়ণ সব কিছুই দেশটি পেয়েছে। ভোগান্তির পর আমরা কোমর সোজা করে দাঁড়িয়েছি, এখনও দাঁড়াচ্ছি। এজন্য আমি ভুলে যেতে চাই ২০১৬ সালের কথা। যেখানে জন্ম হয়েছে মানুষরূপধারী ‘জন্তু’ নিরবাস ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের ও রোহান ইবনে ইমতিয়াজসহ আরও অনেকের। যারা শুধু জীবন নিতে জানে! আমি, আমার ছোট ভাই ফারাজ আইয়াজ হোসেনের মতো বন্ধু চাই। যে আমাকে বন্ধুত্ব শেখাবে, বন্ধুত্বের অর্থ বুঝাবে, যে আমাকে আলোর পথ দেখাবে, ভালো-মন্দ সম্পর্কে জ্ঞান দেবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বে।

 

২০১৬ শেষ! আমি ভুলে যেতে চাই এ বছরটিকে, ১ জুলাইয়ের ব্ল্যাক ফ্রাইডেকে। নতুন বছরের নতুন প্রতিপাদ্য হোক-

চাই নো কোনো নিরবাস

চাই না কোনো মোবাশ্বের

বাঁচার মতো বাঁচতে চাই

ফারাজের মত বন্ধু চাই

 

লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ ডিসেম্বর ২০১৬/ইয়াসিন/তারা