মতামত

আস্থা রাখুন টাইগারদের ওপর

আমিনুল ইসলাম: ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে বদলে যেতে শুরু করে বাংলাদেশের ক্রিকেট। একের পর এক সাফল্য ধরা দিতে থাকে বাংলাদেশের ঝুলিতে। সাফল্যের গ্রাফ সর্বকালের সেরা উর্ধ্বমুখী হয়ে চলতে থাকে। তবে ২০১৭ সালে এসে তা নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত এই পতন কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটাই এখন দেখার বিষয়। আশঙ্কাটা এ কারণে যে, চলতি বছরে বাংলাদেশের ঘরের মাঠে খেলা নেই বললেই চলে। বছরের শুরুতেই নিউজিল্যান্ড সফর। কিউইদের বিপক্ষে ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ১৭ বছরের মাথায় ঐতিহাসিক টেস্ট খেলতে বাংলাদেশ দল এখন ভারতে। ভারত সফর শেষে মার্চে শ্রীলঙ্কা সফরে যাবে টাইগাররা। এরপর মে মাসে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ। জুনে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। আর সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের বিপক্ষে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ। ঘরের মাঠে দারুণ পারফরম্যান্স করা বাংলাদেশ এবার কঠিন পরীক্ষার মুখে। ব্যর্থতার অনুমান নির্ভর পরিসংখ্যান তুলে ধরার আগে চলুন একবার স্মরণ করে আসা যাক সাফল্যের স্মৃতি। ২০১৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজ বাংলাদেশ জিতে নেয় ৩-০ ব্যবধানে। ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। এরপর ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে যায় টাইগাররা। সেখানেও স্বপ্নযাত্রা অব্যাহত থাকে। ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো খেলে কোয়ার্টার ফাইনাল। বিশ্বকাপ থেকে ফিরে এসে ঘরের মাটিতে নাস্তানাবুদ করে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দলকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে। এরপর ভারতের বিপক্ষে ৩ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজ জিতে নেয় ২-১ ব্যবধানে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে জয় পায় ২-১ ব্যবধানে। এরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বাংলাদেশ। তারই অংশ হিসেবে নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলে। সেটি ১-১ এ সমতা থাকে। জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আবার ৪ ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলে সেটাতেও ২-২ এ সমতা থাকে। তার আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে জয় পায় বাংলাদেশ। আর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে হেরে যায় ২-০ ব্যবধানে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপে আরব আমিরাত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে খেলে টাইগাররা। অবশ্য ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে রানার্স-আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় লাল-সবুজ জার্সিধারীদের।এরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে দারুণ খেলে সুপার টেনে ওঠে। সেখানে অবশ্য একরাশ হতাশাই উপহার দেয় টাইগাররা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ফেরার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট লম্বা বিরতিতে পড়ে। সেই বিরতি ভাঙে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ খেলে। একটি ম্যাচ হারলেও ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেয় বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজ বাংলাদেশ হেরে যায় ২-১ ব্যবধানে। কিন্তু মেহেদী হাসান মিরাজের ভেল্কিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি টেস্ট জিতলে বহুদিন পর ঘরের মাঠে ওয়ানডেতে সিরিজ হারার বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায়। এতোক্ষণ বাংলাদেশের সাফল্যের ভেলায় ভেসেছেন। চোখের সামনে জয়ের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠেছে। হৃদয়ে দোলা দিয়েছে একের পর এক সিরিজ জয়ের আনন্দ। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি স্থান করে নিয়েছে। তবে চলতি বছরে একের পর এক ব্যর্থতার গল্প শুনতে হতে পারে। বিষয়টি অনুমান নির্ভর হলেও নির্মম সত্য হয়ে ধরা দিতে পারে চলতি বছরেই। তবে আস্থা রাখুন টাইগারদের ওপর। আর যদি সেটা রাখতে না পারেন তাহলে ব্যর্থতার গল্প শুনতে প্রস্তুত হোন। ডিসেম্বরে বিপিএল শেষ হতে না হতেই বাংলাদেশ উড়াল দেয় অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাষা ছিল বেশ ফুরফুরে। সেখানে দশ দিনের অনুশীলন ক্যাম্পের অংশ হিসেবে দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে মাশরাফি-সাকিবরা। সিডনি সিক্সার্সের বিপক্ষে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে জয় পেলেও হেরে যায় সিনডি থান্ডারের বিপক্ষের ম্যাচটি। এরপর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শুরু হয় ওয়ানডে সিরিজ। সিরিজ শুরুর আগেও বাংলাদেশ দল বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। কিন্তু ব্যাটিং ব্যর্থতায় প্রথম ওয়ানডে হেরে যাওয়ার পরই বদলে যায় বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাষা। ব্যাটিং ব্যর্থতা অব্যাহত থাকায় ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ হয়। তিন ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজও ৩-০ ব্যবধানে হেরে যায় বাংলাদেশ। দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথমটিতে নজির স্থাপন করে হেরে যায়। শেষটিতে হেরে যায় চারদিনেই। টেস্ট সিরিজও হারে ২-০ ব্যবধানে। ভারতের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট খেলতে মুশফিকবাহিনী এখন ভারতে। ভারতের মাটিতে ভারতের বিপক্ষের ওই টেস্ট জয়ের আশা করা যায় না। ড্র করতে পারলেও সেটা জয়ের সমান হয়ে দাঁড়াবে টাইগারদের জন্য। কারণ, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে আমরা পরিপক্ক হয়ে উঠলেও টেস্টে এখনো অপরিপক্ক। যেখানে ভারত ৫ শতাধিক টেস্ট খেলে ফেলেছে। আর আমরা কেবল নব্বই এর কোটা পেরুচ্ছি। ভারতের সঙ্গে টেস্ট খেলে মার্চে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা সফর করবে। দুই ম্যাচ টেস্ট, তিন ম্যাচ ওয়ানডে এবং দুই ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলবে টাইগাররা। শ্রীলঙ্কার মাটিতে তাদের কন্ডিশনে বাংলাদেশ কী সিরিজ জিততে পারবে? প্রশ্নটা তোলা থাকল। এরপর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে যাওয়ার আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় একটি সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ। এই সিরিজে অপর দল নিউজিল্যান্ড। সেখানেও আয়ারল্যান্ডের কন্ডিশনে ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে সিরিজ জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ‘এ’ গ্রুপে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে রয়েছে স্বাগতিক ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তাদের হারিয়ে বাংলাদেশ কতদূর যেতে পারে সেটা সময় বলে দেবে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শেষে সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাবে টাইগাররা। সেখানে দুই ম্যাচ টেস্ট, তিন ম্যাচ ওয়ানডে ও দুই ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষের সিরিজেও একরাশ হতাশা সঙ্গী হতে পারে বাংলাদেশের। আর বছরের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়া দলের বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা রয়েছে। দুই ম্যাচ সেই টেস্ট সিরিজে যদি বাংলাদেশ দারুণ কিছু করতে পারে। আর সেটা না হলে চলতি বছরে ক্রিকেটের ব্যর্থতার একটি বছর হয়ে ধরা দিতে পারে। তবে আস্থা রাখুন। দেশের বাইরে খেলতে খেলতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ। আর একবার যদি তাল পেয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশ কী করতে পারে সেটা ক্রিকেট বিশ্ব ইতিমধ্যে দেখেছে। তাই বলছি- আস্থা রাখুন টাইগারদের ওপর। লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/আমিনুল/তারা