মতামত

লিঙ্গবৈষম্য ও নারীর ব্যক্তিত্ব

নাসিব-ই-নূর: লিঙ্গবৈষম্য বা ‘gender discrepancy’ উচ্চ, মধ্য বা নিম্ন- সমাজের সব স্তরেই বিদ্যমান। পার্থক্য শুধু ধরনের। এটা যে শুধু আমাদের দেশের সমস্যা তা নয়, এই সমস্যা উন্নত বিশ্বেও রয়েছে; তবে হয়তো সংখ্যায় কম। এখন প্রশ্ন হলো, এই সমস্যা কি এক দিনে সৃষ্টি নাকি এগুলো এক দিনে দূর করা সম্ভব? কখনো না। সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে। আমাদের সচেতনতা এই সমস্যা নির্মূল করতে না পারলেও কিছুটা কমাতে পারে হয়তো। ‘লিঙ্গবৈষম্য’ এই কারণে কি একা নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়? এর প্রভাব ও প্রতিফলন রয়েছে সমাজজুড়ে। অনেকটা ক্ষত সৃষ্টি করছে সামাজিক মূল্যবোধে। অর্থনীতির ওপরও এর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। যে মেয়ে সব সময় ঘরে বা বাইরে নিজের অবস্থান নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে, সে তার সন্তানের মধ্যে কীভাবে আত্মসম্মান বোধ সৃষ্টি করবে? আর সন্তান যদি মেয়ে হয় তবে তো কথাই নেই। বর্তমান সময়ে অনেক দেশেই নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা হয়। আমরা অতদূর না ভাবি! যদিও বিচারিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে অনেক দেশের চেয়ে আমরা এগিয়ে। খোদ মার্কিনরা আজও নারীর ক্ষমতায়ন মানতে পারেনি। সেখানে আমরা এগিয়েই বটে। কিন্তু সাধারণ পর্যায়ের মেয়েদের অবস্থা কি এত ভালো? তারা অনেক বেশি বৈষম্যের শিকার। সাধারণত মেয়েরা এর কারণ হিসেবে পুরুষদের দোষারোপ করবেন। কিন্তু আমরা মেয়েরাও কি দায়ী নই? বৈষম্য শুরু হয় আমাদের নিজেদের ঘর থেকেই। আপন মায়ের কাছ থেকে। একটা ছেলেসন্তান আর মেয়েসন্তানের পার্থক্য মায়েরাই বেশি করে- কি খাওয়া-দাওয়া, কি পোশাক, কি লেখাপড়া সব ক্ষেত্রে। এই মানসিকতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, মা থেকে মেয়ে, তার মেয়ে অথবা তারও মেয়ের মধ্যে বহমান। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মা হতে হয় না এর জন্যে। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার এখনই। কোনো রাজনৈতিক শক্তির ছত্রচ্ছায়া বা সুগঠিত নেতৃত্বের দরকার নেই এই বৈষম্য দূর করার জন্য। দরকার শুধু সদিচ্ছা। প্রাইমারি পর্যায় বা তারও কিছু আগে এই বিষয়ে বাচ্চাদের সচেতন করা যেতে পারে। কোনো আলাদা কোর্স সংযুক্ত করার দরকার নেই। সব স্কুলেই প্রতিদিন শরীরচর্চা ও জাতীয় সংগীত অনুষ্ঠিত হয়, সেই  সময় নিজ উদ্যোগেই কোনো শিক্ষক সংক্ষেপে এ বিষয়ে সংক্ষেপে হলেও আলোচনা করতে পারেন। আরো উচ্চপর্যায়ে এসে ‘লিঙ্গবৈষম্য’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হতে হতে, হয়তো ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যেই পরিবারের আজন্ম লালিত ধারণা বদ্ধমূল হয়েই যাবে। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের অনেক কন্যাশিশু প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চপর্যায়ে যেতে পারে না পারিবারিক বা অর্থনৈতিক কারণে। ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুর হাইস্কুলে পড়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কম। আমরা অনেকেই ঈদে বা পূজায় নিজের এলাকায় যাই। আসুন না নিজের স্কুলের কোনো শিক্ষককে উদ্বুদ্ধ করি এই বিষয়ে তার স্কুলে আলোচনা করতে। অথবা পাশের বাসার বউটিকে সচেতন করি তার নিজ সন্তানের মাঝে ছেলে-মেয়ে প্রভেদ না করতে, অথবা নিজের বাসার কাজের মেয়েকেই না হয় বলি সচেতন হতে। এভাবে হয়তো এক থেকে দুই, দুই থেকে চার হয়ে একশ হবে। মেয়েদের জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য অনেকটাই নির্ভর করে এ বিষয়ের ওপর। সুস্থ সন্তান ও সুস্থ মা দেশ ও জাতীর সম্পদ। সন্তান জন্মের পূর্বে মায়ের সুস্বাস্থ্য ও সন্তান জন্মের পরে উভয়ের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় পরিবারকেই সচেতন হতে হবে, এবং এ জন্য আমাদের হতে হবে সচেষ্ট। এবার আসি ‘আমাদের ব্যক্তিত্ত্ব’ প্রসঙ্গে। শিক্ষিত শ্রেণিতেও নারী বৈষম্যের শিকার। এর একটা কারণ হিসেবে বলা যায় তার ব্যক্তিত্বের অভাব। মেয়েরা সার্টিফিকেটের তকমা নিয়ে, নিজ ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বসে আছেন অবলীলায়। আমি পারি না বা পারব না- এই বোধ আমাদের মধ্যে গেঁথে গেছে ত্রিশূলের মতো। বাড়িতে বাজার নেই। অপেক্ষা কখন কর্তা আসবেন! হ্যাঁ কর্তাই বলব। কেন মেয়ে, তুমি কি রাস্তা চেন না? দর্জির দোকানে তো যেতে পার! বাচ্চার পেন্সিল থেকে ডায়াপার সবকিছুতেই কর্তা কেন? তুমি কি একটু ব্যতিক্রমভাবে ভাবতে পারলে না? রিকশা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা বা গাড়ি ঠিক করে দেওয়ার জন্য কেন তুমি অন্যের ওপর নির্ভরশীল? একটা ছেলে তো এই কাজের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করে না! তুমি কি নিজেই তোমার জন্য বৈষম্য তৈরি করছ না? সারা দিন পর তোমার সঙ্গী ঘরে ফিরে দেখল তুমি বিজাতীয় সংস্কৃতিতে বুঁদ। বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল বা স্টার জলসা বা জি বাংলা দেখছ। অথবা মোবাইলে করছ পরচর্চা। তার চেয়ে বরং তোমার হাতে যদি সমসাময়িক কোনো উপন্যাস বা ‘দি ইকোনমিস্ট’ বা ‘গার্ডিয়ান’ এর একটা সংখ্যা থাকত, অথবা চাইল্ড সাইকোলজির একটা বই! তোমার প্রতি তার শ্রদ্ধা বাড়ত বৈ কমত না। কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা হয়তো বা তোমারই হতো! বিছানার চাদর, পর্দা, বালিশ, হাঁড়ি-পাতিল কেনার সময় তোমার পছন্দ প্রাধান্য পায়, কারণ এই বিষয়ে তোমার স্পষ্ট ধারণা আছে। কিন্তু বাড়ির গাড়ি কেনার সময় তোমার মতামত নেই কেন, কখনো এর কারণ ভেবেছ কি? কারণ তোমার জ্ঞানের অভাব। কখনো কি গাড়ির কোন কনফিগারেশন নিয়ে তোমার সঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা করেছ? অথবা নতুন কোনো গ্যাজেট? অথবা কোনো বই বা সংবাদের হেডলাইন? বলতে পারলে দেখতে কতটা সমীহ তোমার জন্য তার চোখে! চার্লস ডারউইনের একটা তত্ত্ব আছে ‘বিবর্তন বাদ’, কম বেশি আমরা সবাই জানি। প্রাণিকুলের ক্ষেত্রে এটা যতটা প্রযোজ্য সম্ভবত নারীকুলের জন্য এটা অনেক বেশি প্রযোজ্য। কোনো এক অজ্ঞাত কারণবশত অথবা কালের বিবর্তনে সমাজে একটা তত্ত্ব প্রচারিত ও প্রচলিত এবং সর্বজন গৃহীত যে, নারী অবলা, শারীরিকভাবে পুরুষের চেয়ে দুর্বল। অস্বীকার করছি না বিধাতার সৃষ্টি হয়তো তেমন, কিন্তু মূল বিষয় হলো বনের বাঘের চেয়ে মনের বাঘ এখানে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ সৃষ্টির ঊষালগ্নে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি কর্মক্ষম ছিল। ক্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ বা ৩০০০ বা এরপরের নৃতাত্বিক বইগুলো পড়লে দেখা যাবে মেয়েরাই প্রতিটি গোত্রের প্রধান ছিল, সেখানে বৈষম্য ছিল না, এমনকি তারা যুদ্ধে সেনাপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো। এই আধুনিক যুগেও আদিবাসী নারীরা এর ব্যতিক্রম নয়। তাহলে কি কিছুটা বৈষম্য আমরাই সৃষ্টি করিনি? ঘরে-বাইরে ‘অবলা, অবলা’ শুনতে শুনতে আমরা যেন মেনেই নিয়েছি আসলেই আমরা অবলা। আমি কথাগুলো কোনো পুরুষের অহমে আঘাত করার জন্য বলছি না, বলছি এই কারণে, যেন নারীরা তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বলিষ্ঠ দিকটি উপলব্ধি করেন।আদিম নারীরা যেখানে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধজয়ও করে ফেলত সেখানে আমরা ভাবি আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়তো দুর্বল! একটা ছেলের সঙ্গে আমাদের কর্মের বৈষম্য আমরাই তৈরি করেছি। শেখার কোনো বয়স নেই।নিজের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করো। তোমার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বৈষম্য কমাবে অনেকটাই। তুমি নিজেও পাবে আত্মতৃপ্তি। লিঙ্গবৈষম্য কোনো নীতিনির্ধারক বা সমাজসেবক কমাতে পারবে না, যত দিন না আমরা মেয়েরা নিজেরা সচেতন হব। আমাদের সমস্যা হলো আমরা বেশি বুঝতে গেলে হয় ‘সুশীল’ নয়তো আঁতেল হয়ে যাই। ‘মানুষ’ আর হতে পারি না। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হলে সব অসম্ভব সম্ভব করা যায় । এখনো সময় আছে নিজেকে মূল্যায়ন করতে শেখা উচিত। আদিমকালের মতো পাহাড় বাইতে না পারো, বৈষম্যের সিঁড়িটা অতিক্রম করো। নিজেকে জানো, বোঝো, অন্যকে বুঝতে দাও তোমার গুরুত্ব। এতক্ষণ যা কিছু আমি বলেছি তা হয়তো অনেকেরই জানা। কিন্তু কখনো সেভাবে হয়তো ভাবা হয়ে ওঠেনি। লিঙ্গবৈষম্যের ফলাফল ভোগ করতে হয় নারী-পুরুষ উভয়কেই। একটু সচেতনতা আমাদের এই সমস্যা মোকাবিলা করার সামর্থ্য দেবে। আসুন সবাই একটু চেষ্টা করি। নিজের আর সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিই। আজ থেকেই পালন করা শুরু করি নিজেদের দায়িত্ব। আমরা পারব, আমাদের পারতেই হবে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৭/তারা/এএন